ইন্দুভূষণ দাস
এপুত্যাজ্যাারপস । ৮৯, অহা গাঁ্দী রোড, ক্সিকাতা-৭
এশ্র্থাআ খল ককণাশ
হআাক্স্মাক্ি ১৯৩০০
হব মোক স্যাক্স
“ক্ষকনাখ্খ বিুপ্টিৎ ওক
১৬৯ বিলোদদ সাক! লন
!
পাস ০৯৯ -্্ট়ি
রা
রি লিগ ক কি ৯০ ৫ রিনি চক বি
মার ডি বন করিবে ২7 ছার আ
পাে কশভিবে আছেশী এটিতে এ আর ৬,
স্টিল চস ্িঞ্্র কপকগ্তা্দ পিপি ও লিজ
উকি সি রিনি পিসির ্্ি
৫9৮ তি রধগ। 01৩ /70/
(কে -
6১147067০৭0 আসরানীয় ঘাযাথত? |
পররারারারররাররারারারাাররররারারহররারারররারাররারারারারাারারাররারারারারারাররাররু
প্লবীজ্রনাথ ও রবীন্দ্র-পরবর্তা হুস্জন অগ্রগণ্য কবির
জীবনী একত্রে এই প্রথষ প্রকাশিত হলে! । পা$ক-
পাঠিকার্দের কাছে বইখানি সমাদ্দত হলে আমাদের
পপ্রচেষ্ট1 সার্থক হবে।
স্্কাশক.
রবীন্দ্রনাথ
॥ বাংল! ও বাঙালীর কবি রবীন্দ্রনাথ ॥
পূর্ববঙ্গের কুশীরী বংশের একটি শাখা কবে এবং কিভাবে
কলকাতায় এসে ঠাকুর পরিবার'-এ পরিণত হলো সে প্রসঙ্গ নিয়ে
আমি আলোচনা করছি না । অথবা, বাংলার সাহিত্যে শিল্পে কিংবা
রাজনীতিতে এই পরিবারের লোকেরা! কে কতখানি অংশগ্রহণ করেছেন,
অথবা, কার কতখানি অবদান সে-কথাও আমাদের আলোচ্য নয়।
আমাদের এই আলোচনা একাস্তভাবেই সীমাবদ্ধ বাংলার
বুলবুল, বাঙালী কবি রবীন্দরনাথেব মধ্যে, যিনি বাংলাকে ভালবেসে
লিখেছেন £
“আমার সোনার বাংল!
আমি তোমায় ভালবাসি ;
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি ।”
সত্যিই বাংলার আকাশ-বাতাস বাঙালী কবি রবীন্দ্রনাথের প্রাণে
বাশি বাজিয়েছে। তাই বাংলার প্রমত্ত। নদী পদ্মার তীরে বসে কবি
লিখেছেন ঃ
“আজি মেঘমুক্ত দিন; প্রসন্ন আকাশ
হাসিছে বন্ধুর মতো! বুন্দর বাতাস
মুখে চক্ষে বক্ষে আসি লাগিছে মধুর-_
অর্দৃষ্ট অঞ্চল যেন মুক্ত দিগবধূর
উড়িয়া পড়িছে গায়ে । ভেসে যায় তরী
প্রশাস্ত পদ্মার স্থির বক্ষের উপরি
প্রবল কল্লোল ।”
গু রবীন্দ্রনাথ
আবার খরজোতা৷ কুলধ্বংসী কীততিনাশা৷ পদ্মার কথ ম্মরণ করে
কবি লিখেছেন £ “কীতিনাশ! মানবের.ভীষণ শিক্ষক ৮
পদ্মা একাস্তভাবেই বাংলার নদী। পুরাঁণে বলা হয়েছে যে,
ভগীরথ যখন সগর বংশকে উদ্ধার করৰার জন্তে তপস্তা করে গঙ্গাকে
ভারতে নিয়ে আসছিলেন,
“আগে চলে ভগীরথ শঙ্খ বাজাইয়া,
পশ্চাতে চলেন গঙ্গ৷ বেণী দোলাইয়া |”
সেই সময় কোন এক শঙ্খচুড় নাকি ভগীরথের রূপ ধরে শঙ্খ বাজ্জিত্ে
গঙ্গাকে ভিন্নপথগামী করে- এবং সেই ভিন্নপথগামিনী গঙ্গাই পরৰর্তাঁ-
কালে পদ্মা নামে খ্যাত হয়।
পুরাণের এ কাহিনী পুরাণের মধ্যেই পুরানে। হয়ে থাকুক, আমরা
বলি, শঙ্খচড় বেঁচে থাক বাঙালীর হৃদয়ে; পদ্মাকে এনে দেবার
জন্যেই সে বেঁচে থাক ।
আবার ভূগোল বলে যে, “রামপুর বোয়ালিয়র কিছু উজানে গঙ্গা
হইতে একটি শাখানদী উৎপন্ন হইয়। রাজসাহী জেলাকে পাশ কাটাইয়া
এবং পাবনা ও ফরিদপুর জেলাকে বিভক্ত করিয়া পূর্বাভিমুখে প্রবাহিষ্ত
হইয়া যমুনার দেহের সঙ্গে একাকার হইয়া গিয়া দক্ষিণা ভিমুখে প্রবাহিত
হইয়াছে ৮ এই নদীই হলো পদ্মা । বাঙালীর কাছে পদ্ম অনন্যা ।
বাঙালী কবির কাছেও তাই পদ্মা অতুলনীয়া। তাই পল্লার রূপ
বর্ণনায় কবি লিখেছেন £
“বক্র শীর্ণ পথখানি দূর গ্রাম হতে
শম্তক্ষেত্র পার হয়ে নামিয়াছে আ্োভে--”
আর এক কবিতায় তিনি লিখেহেন-_
“ডিলঙ্গ বালক তার
সানন্দে বাপায়ে জলে পড়ে বারস্বার
কলহাস্তে ; ধৈর্যময়ী মাতার মত
পদ্মা! সহিতেছে তার গেহ-জালাতল।”
রবীন্দ্রনাথ ণ
বাংলাকে, বিশেব করে বাংলাদেশকে রবীন্দ্রনাথ কতখানি
ভালবাসতেন, সে-কথ! তিনি নিজেই বলে গেছেন £
“আমার জীবনের অনেকদিন নগরের বাইরে পল্লীগ্রামের
গ্রখ-ছুঃখের ভিতর দিয়ে কেটেছে, তখনই আমি দেশের
সত্যিকারের রূপ কি ত৷ অনুভব করতে পেরেছি । তখন আমি
পদ্মা নদীর তীরে গিয়ে বাস করছিলাম "* *-"
সে সময় থেকেই আমার মনে এই চিন্তা হয়েছিল, কেমন
করে এইসব অসহায় অভাগাদের প্রাণে “মানুষ হবার
আকাজ্ষা জাগিয়ে দ্রিতে পারি ।”
এই চিন্তাধারারই প্রতিফলন দেখতে পাই তার আর একটি
কবিতায়, সেখানে কৰি লিখেছেন £
“সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধা জননী,
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ করোনি 1”
বাঙালীর অশিক্ষা আর ছুঃখ দৈন্ত দেখে তাব প্রাণ কেঁদেছে, তাই
তিনি সখেদে বলেছেন ঃ
“এই যে এরা মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ শিক্ষা হতে বঞ্চিত,
খাগ্ হতে বঞ্চিত, এই যে এক বিন্দু পানায় জল হতে বঞ্চিত,
এর কি প্রতিকারের কোন উপায় নেই ?”
কবির এই মানসটি সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তার কবিতায়,
যেখানে তান লিখেছেন £
“এই সব মৃঢ় ম্লান মৃক মুখে দিতে হবে ভাষা,
এইসব শীর্ন শু ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়। তুলিতে হবে আশা”
রবীন্দ্রনাথের এই কবিসত্বার কথ সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন
সুলেখিক! আশাপুর্ণ দেবী। তিনি লিখেছেন £
“রবীন্দ্রনাথের কবিসন্বা, যাকে তিনি বলেছেন “মানঙগী,
কৌতৃহলময়ী, জীবনদেবতা'--সে প্রতিনিয়ত গ্ভার লেখনীকে
টেনে নিয়ে গেছে এক লোকাতীত দিব্য অনুস্ঠুতির স্বরে, সেখানে
৮ রবীন্দ্রনাথ
এই লোকসংসার তার সমস্ত তীব্রতা আর তীক্ষতা নিয়ে
উপস্থিত হতে পারত না, হার মানতো। হার মানতেন কবি
নিজেও । তাই হতাশ-বিন্ময়ে বলেছেন সেই কৌতুকময়ীকে__
“আমি যাহ! চাই বলিবারে,
তাহা বলিতে দিতেছ কই ?
অন্তর মাঝে বসি আছে,
মুখ হ'তে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,
মোর কথা নিয়ে কি যে কথ কহ
মিশায়ে আপন সুরে,
কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই,
তুমি যা বলাও আমি বলি তাই,
সঙ্গীতআ্রোতে কুল নাহি পাই
কোথা ভেসে যাই দূরে ।
বলিতেছিলাম বসি আধারে,
আপনার কথা আপন জনারে,
শুনাতেছিলাম ঘরের ছয়ারে
ঘরের কাহিনী যত।
তুমি সে ভাষায় দহিয়া অনলে,
ডুবায়ে ভাষায়ে নয়নের জলে,
নবীন-প্রতিম! নব-কৌশলে
গড়িলে মনের মত ।”
কবি রবীন্দ্রনাথ ব্যাপ্ত হয়ে আছেন তার কবিত। আর গানের
মধ্যে, কিন্তৃব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন পল্লী-প্রকৃতির প্রেমিক উপাসক-_
পল্লী-মানুষের কাছের মানুষ ।
আর, এই পল্লী হলে ওপার বাংলার পল্লী অঞ্চল এবং পল্লীবাসীরা
হলে! ওপাঁর বাংলার পল্লী অঞ্চলের সাধারণ মানুষের! !
রবীন্নাথ ৯
অনেকে বলেন, রবীন্দ্রনাথ দেশ-কাল-পাত্রের গণ্ডি পেরিয়ে সারা
বিশ্বকে আপনার করে নিয়েছিলেন ; তিনি তাই শুধু বাংলার বা!
ভারতের কবি নন, তিনি বিশ্বকবি । এ-কথা ধারা বলেন তাদের
সঙ্গে আমাদের কোন রকম মতবৈষম্য না থাকলেও রবীন্দ্রনাথকে
ওভাবে দূরে ঠেলে দিতে আমাদের মন চায় না। আমাদের কাছে
রবীন্দ্রনাথ বাংলা তথা বাঙালীর কবি; তাই রবীন্দ্রনাথ আমাদের
একাস্ত আপনার জন- আমাদের একাস্ত প্রিয় ।
কেউ কেউ এমন কথাও বলে থাকেন যে, রবীন্দ্রনাথ বাস্তববাদী
নন, তিনি কল্পলোকের রঙিন পাখ্নায় ভব করে স্বরচিত মনলোকে
বিচবণ করেন। এদের মন্তব্য মেনে নিতে আমর! রাজি নই।
হয়তো তিনি কঠোর বাস্তববাদী নন, নিজের সমস্ত সন্বা বিসর্জন
দিয়ে তিনি নিজেকে বাস্তববাদী করে তোলেননি ; কিন্ত তাই বলে
রবীন্দ্রনাথকে আমর! কখনই অবাস্তব কবি বলে স্বীকার কববো৷ না ;
বরং তাকে ধার! বাস্তববাদী নন বলে অভিমত প্রকাশ করেন তাদের
আমর! অন্থুরোধ করবে তার! যেন রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র এবং পঙ্লী-
বাংলার ওপরে লেখা তার কবিতাগুন্িনি ভাল করে পড়ে দেখেন।
এই প্রসঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীর রচনা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি।
মৈত্রেয়ী দেবী লিখেছেন ঃ
“পদ্মাতীরের জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ সংবাদ তার চিঠিপত্রে
আছে। নানা জনের কাছে এ সময়ে তিনি নান৷ প্রসঙ্গে
চিঠি লিখেছেন, তার মধ্যে “ছিন্নপত্রেণ আমরা সেই পদ্মাতীরের
সীমাহীন সৌন্দর্যের আলোকস্ুধ! পান করে কবির অন্তরের
গভীর অনুভবের সঙ্গে আজো যুক্ত হই। প্রথম আটখানি
ছাড়া “ছিন্নপত্রে'র আর সমস্ত চিঠিই ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে
লেখা । এই চিঠিপত্রগুলির রচনাকাল আট-নয় বংসরব্যাগী ।
কবির বয়স তখন পঁচিশ থেকে তেত্রিশের মধ্যে এবং ইন্দিরা
দেবীর বারে! থেকে যথাক্রমে তূর্ধ্বে। উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝখানে
রবীন্দ্রনাথ
থেকে শহরবাসিনীকে লেখা এই চিঠিগুলির মধ্যে, কবির
নিগৃঢ় স্বরূপ যেমন অভিব্যক্ত, এমনটি বোধ হয় আর কোথাও
হয়নি । বিশেষত ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-ছুঃখ কাব্যে
র্যক্তিগতভাবেই প্রকাশ করা তার ম্বভাব ছিল না, যখন জীবন
ভোগের মন্থনোভ্ভূত রস সকলের হয়ে উঠত তখনই তা কাব্যের
যোগ্য বলে সাহিত্যে স্থান পেত। তার জীবনটি স্পষ্টভাবে
তাই কাব্যে পাই না ।”
কাব্যে তার জীবনকে স্পষ্টভাবে পাওয়। যায় না বলেই বিভিন্ন
সমালোচক তাকে বাস্তববাদী নন বলে মত প্রকাশ করেছেন ।
“ছিন্নপত্রের মধো তিনটি বিশেষ ধারা আমরা পাই,
একটি বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের ঘনিষ্ঠ ঘরোয়া ছবি, আর
একটি বাংলাদেশের সৌন্দর্যময়ী প্রকৃতি । তৃতীয় _ এই ছই-এর
সঙ্গমে উদ্ভৃত কবির মনন ও তন্ববাণী।******
বাংলাদেশের খড়ে-ছ।ওয়া মাটির ঘরের বড় কাছাকাছি
এসেছিলেন কবি। পদ্মার জলে ভাসছে তাঁর নৌকা, তিনি
দেখেছেন ছ'পাশের জীবনসীমা- কখনো বা কল্পনায় একেবারে
তাদের সুখ-ছুঃখ ভোগ করছেন। কোন মেয়ে শ্বশুরবাড়ি
যেতে জলভরা চোখে নৌকায় উঠল, তার ভবিষ্যৎ কল্পন! গল্পের
বীজ বুনছে। কোথাও বা শীতকালের: ভোরে ক্রন্দনরত
শিশুকে ঠাণ্ডা জলে স্নান করাতে চড়-চাপড় মারছে ধৈর্যহীনা
জননী। শীতার্ত শিশুর সেই আর্তম্বর আর্ত করে তুলেছে তার
স্বন্দর সকাল-_
“একে এই ভোরের শীতে কনকনে জলে চান তারপরে
আবার রাক্ষপীর হাতের মার।” এই চিঠিগুলি পড়তে পড়তে
গ্রামের দৈনন্দিন জীবনের আলো-ছায়! আজও স্পষ্ট হয়ে ওঠে
__কি আশ্চর্য সন্দয় দৃষ্টিপাতে কবি দেখেছেন সুখ-হঃখমাখা.
হাঁসি-কান্সাভরা মানুষের বড় ভালোবাসার জীবন। আর
রবীন্দ্রনাথ ১১
দেখেছেন নদী-খাল-বিল-তাল-নারিকেল কুঞ্জ। অবাবিত
প্রান্তরে সূর্যোদয়ের ও অস্তের সমারোহ, মাথার উপরে শুধু
নীলাকাশের জ্যোতিঃবিকীর্ণ মহোৎসব--»
এই হলেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ । বাঙালীর একান্ত প্রিয়
বাঙালীর কৰি রবীন্দ্রনাথ । এই কবিব কথাই আমরা আলোচন৷
করৰো এখানে ।
তৰে, এসব কথ বলবার আগে কবির জীবন-কথা! সংক্ষেপে বলে
নিতে চাই ।
॥ সতক্ষিগত জীবন-কথা ॥
€জাড়াসীকোর ঠাকুরবাড়ি।
আমরা অর্থাৎ হিন্দুরা ঠাকুরবাড়ি বলতে সাধারণত বুঝি দেবালয়
বা মন্দির ; অর্থাৎ যেখানে মৃন্ময় বা প্রস্তরময় দেবতারা বিরাজিত
থেকে ভক্তজনের পুজার্চনা গ্রহণ করেন। কিন্তু জোড়াসাকোর
ঠাকুরবাড়ি সে অর্থে ঠাকুরবাড়ি নয়। ঠাকুর পরিবারের বসতবাড়ি
বলেই জ্োড়া্সকো পল্লীর একটি বিশেষ বাড়িকে লোকে বলে
ঠাকুরবাড়ি।
এই ঠাকুরবাঁড়ির পত্তন করেছিলেন নীলমণি ঠাকুর। ইনি ছিলেন
প্রিন্স ছারকানাথ ঠাকুরের পিতামহ । দ্বারকানাথ ছিলেন রামমোহন
রায়ের সমসাময়িক ব্যক্তি. এবং তীর একজন বিশেষ বন্ধু। রামমোহন
ফখন সভীদাহ প্রথা! রদ করবার জন্তে আন্দোলন শুরু করেন, তখন
দ্বারকানাথ অকুষ্টিতচিত্তে তীকে সমর্থন করেন। এছাড়া বাংলাদেশে
ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তনের ব্যাপারেও ছ্বারকানাথের দান অপরিসীম ।
রাঁমমোহনের মত তিনিও বিলাতে গিয়েছিলেন । বিলাত হতে
ফিয়ে এলে তার আত্মীয়-ঘজনর! তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে বলেন ;
১২ রবীন্দ্রনাথ
কিন্তু দ্বারকানাথ তাদের কথায় প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজী হন নঃ। তিনি
বলেন, “আমি এমন কোন অন্ঠায় বা পাপ কাজ করিনি যার জন্যে
আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে ।”
দ্বারকানাথের আর এক কীন্তি হলো ইংল্যাণ্ডে রামমোহন রায়ের
সমাধিক্ষেত্রে একটি স্মৃতিস্তন্ত নির্মাণ ।
দ্বারকানাথের জ্ঞোষ্ঠ পুত্র দেবেন্দ্রনাথ । এঁর স্তায়পরায়ণতা ও
ধর্মসাধনার জন্তে লোকে তাকে “মহঙ্ি বলে ডাকতো । আসলেও
তিনি মহষিই ছিলেন। পুরাণে মহধিদের যে-সব গুণাবলীর কথা উক্ত
আছে, তার প্রত্যেকটি গুণই দেবেন্দ্রনাথের মধ্যে বিষ্ভমান ছিল, এবং
এই কারণেই লোকে তীকে মহধি বলে ডাকতো । ইনিই আমাদের
প্রিয় কবির জনক । মহধির স্ত্রীর নাম সারদা দেবী ।
॥ জন্ম ও বাল্যকাল ॥
আজ বাংলা মাসের যে বিশেষ দিনটি রবীন্দ্রজন্মদিবসবপে
পালিত হচ্ছে, সেই বিশেষ দিনটির স্চনা হয় ১২৬৮ সালের পঁচিশে
বৈশাখ ( ইংরেজী ১৮৬১ গ্রীষ্টাব্দের ৭ই মে) তারিখে । সেদিন ছিল
রবিবার । এবং রবিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলেই তার নামকরণ
হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ।
মহর্ির সন্তানের সংখ্যা ছিল পনেরটি। রবীন্দ্রনাথ তার চতুর্দশ
সম্তান।
ঠাকুর প্ররিবারটি সে সময় কলিকাতার অন্যতম ধনী পরিবার বলে
খ্যাত ছিল। তাই বাড়িটি সব সময়েই লোকজনে পূর্ণ থাকতে।।
আত্মীয়-স্বজন, নায়েব-গোমস্তা পাইক-পেয়াদা এবং বি-চাকরে বাড়ি
গম-গম করতো । এই পরিবেশেই বড় হতে থাকেন কবি । মহর্ষি
তখন বাড়িতে কমই থাকতেন? বিরাট সংসারের দেখাশুনার ভার
রবীন্দ্রনাথ ১৩
ছিল সারদা দেবীর ওপর । তাই ছেলেদের দিকে তিনি নজর দেবার
সময়ই পেতেন না; ফলে শিশু রবিকে থাকতে হতোঁ চাকরদৈর
হেফাজতে ।
ঠাকুরবাড়িতে তখন শ্যাম নামে একটি চাকর ছিল । তার ওপরেই
ছিল রবীন্দ্রনাথের দেখাশুনার ভার । কিন্তু শিশুকে দেখাশুনা করবার
মত বাজে কাজে সময় নষ্ট করার চেয়ে আড্ডা আর ইয়াফ্কি দেবার মত
আসল কাজের দিকেই তার বেশি নজর ছিল। সে তাই ভেবেচিন্তে
একটি মোক্ষম পথ বের করে ফেললো । সে রবীন্দ্রনাথকে দোতলার
একটি ঘরে বসিয়ে তার চারপাশে খড়ির দাগের গণ্ডি'একে বলতো
যে, এই গণ্ডির বাইরে এলে মহাবিপদ হবে।
কিযে বিপদ ত৷ রবীন্দ্রনাথ জানতেন না ; তবে লক্ষ্পণের দেওয়।
গপ্ডির বাইরে আসায় সীতাদেবীকে যে রাবণের হাতে ধরা পড়তে
হয়েছিল, সেকথা তিনি মায়ের মুখে শুনেছিলেন, এবং তা শুনে-
ছিলেন বলেই তিনি গণ্ডির বাইরে আসতে ভীষণ ভয় পেতেন । তাই
শ্যাম এসে তীকে মুক্তি-না-দেওয়া-পর্বন্ত তিনি সেই গণ্ডির ভেতরেই
বসে থাকতেন
এমনি করেই শৈশবের দিনগুলি কাটছিল কবির । কিন্তু তার
বয়স যখন চার পেরিয়ে পাচ বছরে পড়লো তখন হঠাৎ তিনি
মুক্তিলাভ করলেন শ্যামের গণ্ডি থেকে ।
কিন্ত শ্বামের জেলখান! থেকে মুক্তি পেলেও আর এক জেলখানায়
ঢুকে পড়লেন তিনি। এটি হলো! গুরুমশীয়ের জেলখানা । পাঁচ
বছর বয়সে তাঁর লেখাপড়া শুরু হয় মাধব পণ্ডিতের কাছে। পণ্ডিত-
মশাই তার সমস্ত পাণ্ডিত্য প্রকটিত করে পড়ুয়াকে মানুষ করতে লেগে
গেলেন। সে এক ভীষণ পড়া। সকাল থেকে রাত আটটা-নটা
পর্যন্ত চলছে তে৷ চলছেই পড়াশুনা । পণ্ডিতমশাই ছাড়া আরও
কয়েকজন মাস্টার নিযুক্ত কর৷ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের জন্তে তারাও
প্রাপপণে পড়িয়ে চলেছেন ছাত্রকে । বাংলা, ইংরেজী, সক্কত, বিজ্ঞান
১৪ রবীন্দ্রনাথ
_ সৰই তাঁরা পড়াতেন। আবার পড়াশুনা ঠিকমত চলছে কিন!
ভারে জঙ্টে খবরদারি করতেন কবির মেজদা হেমেন্দ্রনাথ ।
এমনি করে এক বছর পড়াশুনায় তালিম দেবার পর রবীন্দ্রনাথকে
ভরি করা হলে! ওরিয়েপ্টাল সেমিনারীতে। ওখানে বছরখানেক
পড়বার পরে তাকে ভি করা হলো নর্মাল স্কুলে, এবং আরও
কিছুদিন পরে বেঙ্গল একাডেমি নামে একটা ফিরি স্কুলে ।
বেঙ্গল একাডেমিতে কিছুকাল পড়াশুনা করবার পর মহষ্ষি তাকে
ৰোলপুরে নিয়ে গেলেন।
বোলপুরে এসেই রবীন্দ্রনাথ প্রথম মুক্তির স্বাদ পেলেন। ওখানে
তিনি নিজের মনে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতেন। মহধি এতে বাধ!
দিতেন না।
বোলপুরে কিছুদিন রেখে মহষি তাকে আবার কলকাতায় এনে
সেই বেঙ্গল একাডেমিতেই পুনরায় ভতি করে দিলেন। কিন্তু
এখানে পড়তে রবীন্দ্রনাথের ভাল লাগতো না। তার মনে হতে।
স্ভাকে যেন জেলখানায় বন্দী করে রাখা হয়েছে। ববীন্দ্রনা্থ তাই
প্রায়ই স্কুল থেকে পালাতে লাগলেন ।
খবরট! রবীন্দ্রনাথের অভিভাবকদের কানে যেতে দেরি হলে না ।
তারা তখন রবীন্দ্রনাথকে বেঙ্গল একাডেমি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে
সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভি করে দিলেন। কিন্তু সেখানেও সময়
নষ্ট ছাড়া আর কিছু হলো না। ববীন্দ্রনাথের দাদার তখন রাগ
করে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ কবে দিলেন। তার স্কুলের পাঠ
এখানেই শেষ হলো ।
॥ কবিতাচ্চা ও বিলাতযাত্র। ॥
কবিতার ওপরে রবীন্দ্রনাথের ঝৌক দেখা যায় তার শিশুকাল
থেকেই। তিনি যখন সবেমাত্র অআ ক খ শিখছেন, এই সময়
রবীন্দ্রনাথ ১৫
একদিন বিদ্যাসাগরের লেখা! বর্ণপরিচয় বইটি পড়বার সময় ছোট্ট ছুটি
ৰাক্য পড়ে বিশ্মিত হলেন। বাক্য ছুটি হলে ঃ জল পড়ে, পার্তী
নড়ে। “পড়ে? আর '“নড়ে'__-কী চমৎকার মিল! “জল পড়িতেছে*,
“পাত নড়িতেছে' নয়--'জল পড়ে, পাতা নড়ে । মিলের দোলায়
দুলে উঠলো শিশু-কবির কচি মন।
এবং সে দিনের সেই সুন্দর প্রভাতে কবির মনোগ্ভানে যে জল
পড়তে এবং পাতা নড়তে লাগলো, তাই হলো রবীন্দ্র-কাব্যের
উৎসমূল। একদা মিলনরত ক্রৌঞ্চ-দম্পতিকে লক্ষ্য করে এক নিষাদ
খনুকে তীর সংযোগ করছে দেখে বাল্সীকি মুনির মুখ থেকে যে কবিতার
উৎস নির্গত হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের মুখ থেকে তেমন কোন কবিতা
নির্গত না হলেও তার মনোজগতে সেই 'জল পড়ে-_পাতা নড়ে' যে
মিলের মাল গেঁথে দিয়েছিল, উত্তরকালে সেই জল বনাধারার
আকারে এবং সেই পাতা ফল-ফুল-পল্লবে সুসজ্জিত হয়ে আমাদের
কাছে উপস্থিত হয়েছে অনবদ্ কবিতারূপে ।
রবীন্দ্র-জীবন-চরিত পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই
ষে, প্রথম জীবনে স্কুলের লেখাপড়ার দিকে অমনোযোগী হলেও
কৰিতা পাঠ এবং কবিতা রচনার প্রয়াসের প্রতি তিনি কোন দিনই
জমনোযোগী ছিলেন না।
শিশুকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথ কবিত। লিখতে শুরু করেন। শিশু
কৰির লেখনি হতে প্রথম যে কবিতাটি জন্মলাভ করে সেটি হলো £
আমসত্ব হুধে ফেলি
ছাহাতে কদলি দলি
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে-_
হাপুস্ ছপুস্শব .
চারিদিক নিস্তব্ধ,
পিঁপিড়। কাদিয়া যায় পাতে।
কবিত। হিসেবে এর তেমন কোন মূল্য না থাকলেও, যে বয়সে
১৬ রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ আমসত্ব কদলি আর ছুধ দিয়ে এই অপূর্ব মিষ্টাক্টটি তৈরি
করেছিলেন, তাতে তার মূল্য যথেষ্টই রয়েছে বৈকি !
এই কবিতার পরেই শিশু কবি পয়ার ছন্দে কবিতা লিখতে
শুরু করেন।
এর পর যতই তার বয়স বাড়তে লাগলে। ততই কবিত। লেখায়
তার হাতও ভ্রমশঃ খুলতে লাগলো । তাই আমর! দেখতে পাই যে,
কবির বয়স যখন মাত্র বারো বছর তখনই তার কবিতা বিভিন্ন
সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ওই সময়ে তার লেখা একটি
কবিতার নাম ছিল “অভিলাষ । তার প্রথম চারটি লাইন হলো £
“জনমনোমুগ্ধকর উচ্চ অভিলাষ !
তোমার বন্ধুর পথ অনন্ত অপার ।
অতিক্রম করা যায় যত পাশ্থশাল।,
তত যেন অগ্রসর হতে ইচ্ছা হয় ।৮
এই সময় কবির দাদ! জ্যোতিরিক্দ্রনাথ '“পুকষ বিক্রম” নামে
একটি নাটক রচনা করেন। সেই নাটকে রবীন্দ্রনাথ একটি গান
লিখে দিয়েছিলেন । গানটি হলে! ঃ
“এক সুত্রে বাধিয়াছি সহত্রটি মন,
এক কার্ষে সপিয়াছি সহস্র জীৰন ।
আস্থক সহস্র বাধা, বাধুক প্রলয়-_
আমরা সহত্র প্রাণ রহিব নির্ভয়।”
জ্যোতিরিক্দ্রনাথের “সরোজিনী” নাটকে বালক-কবির একটি গান
আছে। ওই নাটকে রাজপুত নারীদের চিতায় আত্মান্থতি দানের
একটি দৃশ্য আছে। জ্যোতিরিজ্দ্রনাথ সেই দৃশ্যের জন্য একটি বক্তৃতা!
রচনা করেছিলেন । সেই বক্তৃতাটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন--এখানে
গছ্ভের পরিবর্তে পদ্ভ লিখলে ভাল হয়।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন-__তা৷ তো৷ বুঝলাম, কিন্ত পছটি লিখৰে
কে? তুমি পারবে!
রবীন্দ্রনাথ ১৭
রবীন্দ্রনাথ বললেন- দেখি চেষ্টা করে।
ওই কথা বলেই তিনি কাগজ-কলম নিয়ে বসে গেলেন এবং
কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা কবিতা লিখে দাদার হাতে দিয়ে
বললেন--দেখ তো, এটা চলবে কি না।
কবিতাটি. পড়ে জ্ঞোতিরিন্দ্রনাথ খুবই খুশী হলেন। তিনি
বললেন-_নিশ্চয় চলবে । ওই দৃশ্যে এই কবিতাটি দিলে চমৎকার
হবে। কবিতাটি হলো! € ূ
“জ্বল্ বল্ চিতা দিগুণ ছিগুণ
পরাণ সঈঁপিবে বিধবা বালা।
জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন,
জুড়াবে এখনি প্রাণের জ্বালা |?
“সরোজিনী' নাটকের জন্তে এই কবিতাটি লিখবার পর থেকেই
শুর হলো! রবীন্দ্রনাথের লেখা । এর পর তিনি “বনফুল' নামে,
একটি সম্পূর্ণ কাব্য লিখে ফেললেন। তীর বয়স তখন মাত্র
ষোল বছর।
“বনফুল'-এর পরেই লেখা হলো “কবি-কাহিনী” এবং আরও
অনেক কবিত।। পরবর্তীকালে ওই সব কবিতা সংগ্রহ করে 'শৈশব-
সঙ্গীত' নামে একটি বই বের করা হয়। “ভাম্ুসিংহের পদাবলী,ও
এই সময়েই রচিত হয়।
এই সময় একবার মাঘ-উৎসব উপলক্ষ্যে রবীজনাথ কতকগুলি
গান রচনা করেন। মহধি তখন বাড়িতে ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে
ডেকে তার কবিতা শুনতে চাইলেন। কবি তখন হারমোনিয়ম
বাজিয়ে অনেকগুলি গান গেয়ে বাবাকে শুনিয়ে দিলেন। কবির
কণ্ঠে তাঁর নিজের রচিত গানগুলি শুনে মহধি খুশী হয়ে তাকে পুরস্কৃত
করলেন। সে পুরস্কার হলে। পীচশে। টাকার একখান। চেক। এই
হলে রবীন্দ্রনাথের কবি-জীবনের প্রথম স্বীকৃতি।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ঠাধুরধাড়িতে তখন প্রায়ই সাহিত্যিকদের
১৮ রবীন্দ্রনাথ
"সম্মেলন হতো । একবার এমনি একটি সম্মেলনেই বহ্িমচন্ট্রের
সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয় ।
আর একবার এমনি একটি সম্মেলন উপলক্ষে “বাল্সীকি-প্রতিভা।
নাটকটি অভিনীত হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাতে অংশগ্রহণ
করেছিলেন। বাল্ীকির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি ।
এইভাবে সাহিত্য সঙ্গীত আর অভিনয়ের ভেতর দিয়ে মহা"
আনন্দে রবীন্দ্রনাথেরও দিন কাটছিল । কিন্তু এ আনন্দ বেশিদিন
স্থায়ী হলো না। রবি লেখাপড়া ছেড়ে কবিতা লিখে দিন কাটাচ্ছেন
শুনে তার দাদা সত্যেন্দ্রনাথ তাকে নিজের কাছে আমেদাবাদে নিয়ে
গেলেন। তিনি তখন আমেদাবাদের ডিস্ট্রিক্ট আও সেসন জজ ।
এখানে আরও একটা কথ! বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে,
সত্যেন্্নাথই ছিলেন ভারতের সর্বপ্রথম আই. সি. এস্.।
সত্যেন্্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী এবং তার ছেলেমেয়ে স্ুরেন্্রনাথ
ও ইন্দিরা তখন ইংল্যাণ্ডে বাস করছিলেন । সত্যেন্দ্রনাথ তাই রবিকে
তাদের কাছে রেখে লেখাপড়া শেখাবার উদ্দেশ্টে বিলেতে নিয়ে
যাবেন বলে মনে মনে স্থির করলেন ।
এর পর তিনি কিছুদিনের ছুটি নিয়ে ১৮৭৮ গ্রীষ্টাবের সেপ্টেম্বর
মাসে বিলাত যাত্র! করলেন ।
বিলাতে গিয়ে ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি কর! হলো
রবীন্দ্রনাথকে । কিন্তু সে স্কুলে বেশিদিন তার পড়াশুনা হলে! না।
সত্যেন্দ্রনাথ তখন তার লগ্ুনস্থ বন্ধু তারকনাথ পালিতের সঙ্গে পরামর্শ
রুরে রবীন্দ্রনাথকে লগুন ইউনিভার্সিটিতে ভি করে দিলেন।
গুনে তার থাকার ব্যবস্থা হলে ভক্উর স্কট নামে এক ভত্রলোকেন্র
বাড়িতে ।
লগ্নে বছর দেড়েক পড়াগুন। করবার গর জাবার €ঘশে মরলেন
রবীন্দ্রনাথ ১৯
রবীন্দ্রনাথ । এখানেই তার “আকাডেমিক ক্যারিয়ার শেষ হলো?।
এবং এর পরেই শুরু হলে! তার অনেক “ক্যারিয়ার অর্থাৎ কাব্য চর্চা
এবং কবিতা ও গান রচনা । নিরলসভাবে অবিশ্রাস্ত চলতে লাগলো
তার লেখনী ।
॥ রবীব্্রসাহিত্যের বহুমুখী প্রকাশ ॥
রবীন্দ্রনাথের জ্যোতিদা তখন সন্ত্রীক চন্দননগরে বাস করছিলেন ।
বাড়িট। ছিল সুন্দর একট৷ বাগানবাড়ি। কিছুদিন পরে রবীন্দ্রনাথ
সেখানে এসে হাজির হলেন। কবি-ভাইকে পেয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
খুবই খুশী হলেন, এবং তাকে ওখানে কিছুদিন থেকে যেস্ে
বললেন। রবীন্দ্রনাথও খুশীমনেই রাজী হলেন দাদা-বৌদির কাছে
থাকতে ।
ওই বাড়ির ওপরতলায় সুন্দর একটি ঘর ছিল। সেই ঘরে বসে
শুরু হলো তার সাহিত্য-সাধনা। বর্তমানে “সন্ধ্যাসঙীত” নামে বে
বইটি বিশ্বভারতী হতে প্রকাশিত হচ্ছে তার বেশির ভাগ ৰৰিতাঈ
চন্দননগরের ওই বাড়িতে বসে রচন! করেছিলেন কবি।
ওই কবিতাগুলি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের
নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। খ্যাতনাম৷ সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র
রবীন্দ্রনাথের কবিতাগচলোর বিশেষ প্রশংসা করেন। ৰঙ্চিমচন্জর
রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে এবং কবি রবীন্দ্রনাথকে কি চোখে দেখতেন
তার প্রমাণ হিসেবে এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি।
সেই সময় রামবাগানের দত্তবাড়ির সুবিখ্যাত রমেশচজ্ গন্ছের
মেয়ের বিয়ে হয়। বঙ্কিমচন্দ্রও উপস্থিত ছিলেন সেই রিয়েবাড়িছে।
কিছুক্ষ” পরে' রমেশচজ্্র একছড়। মালা এনে বঙ্িমচজ্ের গলায়
২* রবীন্দ্রনাথ
পরিয়ে দিতে গেলে বঙ্কিমচন্দ্র রমেশবাবুর হাত থেকে মালাটা
নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন-_-“এ মাল।
এরই প্রাপ্য 1৮
এর পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চন্দননগর থেকে কলকাতায় এসে সদর
স্্ীটে বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে বাস করতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ
তার সঙ্গে সে-বাড়িতেও ছিলেন । ওই বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ যে
সব কবিতা লেখেন সেগুলি এখন 'প্রভাত-সঙ্গীত, নামে সুপরিচিত।
ওধানে থাকাকালেই রবীন্দ্রনাথ তার বিখ্যাত কবিতা “নির্ঝরের
স্বপ্নভঙ্গ” রচন। করেন ।
এই সময়ে সত্যেন্দ্রনাথ কারোয়ারে বদলি হয়ে এসেছিলেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তার স্ত্রীও ছোটভাই রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে করে তার
বাড়িতে কিছুদিন বাস করেন। ওই বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ তার
বিখ্যাত কাব্য “প্রকৃতির প্রতিশোধ” রচনা! করেন ।
কারোয়ার হতে জোড়াসীকোর বাড়িতে ফিরে আসবার কিছুদিন
পরেই রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হয়। তার বয়শ তখন তেইশ বছরের
কাছাকাছি।
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের কিছুদিন পরে জ্যোতিরিন্্রনাথ লোয়ার
সারকুলার রোডে একটি বাড়ি ভাড়া করে বাস করতে থাঁকেন।
রবীন্দ্রনাথও কিছুদিন তার সঙ্গে সেই বাড়িতে ছিলেন। এই সময়
তিনি যে-সব কবিতা! রচন। করেন সেগুলি “ছবি ও গান” নামে ১৮৮৪
গীষ্টাব্ে প্রকাশিত হয় । এর এক বছর পরে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর
সম্পাদনায় “বালক' নামে একটি শিশু-পত্রিক৷ প্রকাশিত হয়। ওই
পত্রিকার জন্মকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথ তাতে কবিত৷ লিখতে থাকেন।
রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত রচনা 'রাজর্ধি-ও ওই পত্রিকাতেই ধারাবাহিক
রচন। হিসেবে প্রকাশিত হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে পরবর্তীকালে ওই
রবীন্দ্রনাথ ২১
'রাজধি'র গল্পাংশ নিয়েই রচিত হয় রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত নাটক
“বিসর্জন? | ৃ
এই সময় “ভারতী” নামে একখানি পত্রিকা খুবই জনপ্রিয় ছিল।
সেই পত্রিকাতেই রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত কবিতা লিখতেন ।
রবীন্দ্রনাথের জীবনটা সে সময় বেশ আনন্দেই কাটছিল; কিন্তু
হঠাৎ এমন একটা শোকাবহ ঘটন! ঘটে যায় যার ফলে তার সমস্ত
আনন্দ নিদারুণ শোকে পরিবতিত হয়ে যায়। এই শোকাবহ ঘটনাটি
হলো রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌদির অকালমৃত্যু ।
বৌদির শকালমৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ শোকে একেবারে মুহামান হয়ে
পড়েন। তবে, আত্মীয়-বিয়োগ-ব্যথা যেহেতু দীর্ঘস্থায়ী হয় না,
সেইহেতু রবীন্দ্রনাথের মনের আকাশ থেকে শোকের কালোমেঘ
ধীরে ধীরে অপস্ত হয়ে সেখানে উদয় হলো পুর্ণ শশধর । আবার
তিনি শুরু করলেন কবিতা রচনা । এর কিছুদিন পরেই (অর্থাৎ
১৮৮৬ শ্রীষ্টাব্ধে ) “কড়ি ও কোমল" প্রকাশিত হলো । তার বয়স
তখন পঁচিশ বছর ।
“কড়ি ও কোমল" প্রকাশিত হবার কয়েকদিন পরে রবীন্দ্রনাথ
কিছুদিন পশ্চিম ভারতের গাজিপুর শহরে বাস করেন। সেখানে
তিনি যে সব কবিতা রচন। করেন সেগুলি পরবতাকালে একত্রে গ্রথিত
হয়ে “মানসী? নামে প্রকাশিত হয়।
গাজিপুর হতে কলকাতায় ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন
“মায়ার খেলা” গীতিনাট্য। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য যে, রবীন্দ্রনাথের প্রথম নাটক হলো রাজা ও রানীঃ।
এটি তিনি রচনী করেন আঠাশ বছর বয়সে, মনে হয় তার দাদা
€ সত্যেন্্রনাথের ) বাংলোয় বসে। পরবীকালে এই নাটকের
কাহিনী নিয়েই রচিত হয় “তপতী” নাটক ।
॥ শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে ॥
অনেকেই বলে থাকেন যে, সরম্বতীর সাধনা যার! করে তাদেব
প্রতি লক্ষ্মীদেবী নাকি বিরূপ হয়ে থাকেন ; আবার লক্ষ্মীর সাধনা
যারা করে তার! সরম্বতীর আশীর্বাদ পায় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের
বেলায় এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। তিনি একই সঙ্গে সরম্বতী এবং
লক্ষ্মী উভয়েরই সাধনা করেছেন, এবং সে-সাধনায় সিদ্ধিলীভও
করেছেন । তাই আমব। দেখতে পাই, কবি হিসেবে সারা বিশ্বে
তিনি যখন স্বীকৃতি লাভ করেছেন সেই সময় তিনি সুষ্ঠুভাবে জমিদারী
পরিচালনাও করেছেন।
সোলাপুর হতে রবীন্দ্রনাথ বাড়িতে ফিরে আসবার কিছুদিন পরেই
মহত্ষি তাকে শিলাইদহে পাঠালেন জমিদারী পরিচালন। করতে।
রবীন্দ্রনাথ আপত্তি করলেন না । জীবনকে তিনি নানাভাবে দেখতে
চাঁন। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে চান জীবনের নানা ক্ষেত্রে। তাই
তিনি একদিন শুভক্ষণ দেখে রওনা হলেন শিলাইদহের কুঠিবাঁড়
অভিমুখে ।
শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেলেন যে,
বাড়িটা পদ্মা নদীর কাছাকাছি অবস্থিত। শুধু তাই নয়, জমিদারের
ব্যবহারের জন্তে একটা সুন্দর বজরাও আছে । .বজরাটা দেখে ভারী
খুশী হলেন রবীন্দ্রনাথ । সেই বজরায় বসেই তার দণ্তর চালাতে
লাগলেন ।
শিলাইদহের সেই কুঠিবাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ এক নতুন জগতের
সন্ধান পেলেন। সে জগৎ হলো! পূর্ববঙ্গের পল্লী-জগৎ। এখানে
আসবার আগে পল্লীগ্রাম এবং পল্লীবাসীদের সম্বন্ধে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
ভার একেবারেই ছিল না। এই প্রথম তিনি কাছে থেকে দেখলেন
নুখ-ছুখ হাসি-কান্নাভরা পল্লীবাংলার দরিদ্র এবং সরল মানুষদের ।
শুনলেন লালন ফকিরের অপূর্ব পল্লীগাথ!।
রবীন্দ্রনাথ ২৩
পল্লী-কবি লালন ফকিরের সহজ সরল অথচ প্রাণময় গানগুলে।
তাকে মুগ্ধ করলো। তিনি তা লালন ফকিরের প্রতি তার অন্তরের
শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন তার বাঁসস্থানে একটি পাকা দালান তৈরি করে
দিয়ে। ফকিরের মাটির ঘর যাতে কালের কবলে ন্ট হয়ে ন৷ যায়
সেই উদ্দোশ্যেই রবীন্দ্রনাথ বাড়িটিকে পাকা করে দেন। অনেকের
ধারণা (এবং সে ধারণা তারা লিখিতভাবেও ব্যক্ত করেন) যে,
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালন ফকিরের দেখা হয়েছিল এবং তিনি ফকিরের
মুখে তার স্বরচিত গান শুনেছেন। কিন্তু এটা যে সঠিক নয় তার
প্রমাণ পাওয় যায় সৈয়দ মুর্তাজা আলির লেখা! “সাহিত্যতীর্থ শিলাইদহ'
শীর্ষক প্রবন্ধে । সৈয়দ সাহেব লিখেছেন £
«কেউ কেউ লিখেছেন লালন ফকিরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের
দেখাশুনা ও আলাপ-আলোচনা হ'ত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের
সঙ্গে লালন ফকিরের ব্যক্তিগত পরিচয়ের কোন বিশ্বাসযোগ্য
প্রমাণ নেই। তবে, কবি লালন ফকিরের মারফতী গানের
ভক্ত ছিলেন; তার কাব্য-রচনায় ও রস-সাধনায় এই পল্লীর
ছলাল জনপ্রিয় মরমী কবির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
রবীন্দ্রনাথ লালনের অনেক গান সংগ্রহ করে মাসিকপত্রে
প্রকাশ করেন ।-*"তার জমিদারীসংলগ্ন ছেউড়িয়৷ গ্রামে
লালন ফকিরের কবর আছে । রবীন্দ্রনাথ নিজব্যয়ে লালন
ফকিরের আস্তানায় একটি পাক। দালান তৈরি করে দেন।
এই আস্তানা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল ।”
উপরি-উক্ত উদ্ধতি-থেকে স্পষ্টই বুঝতে পারা যায় যে, লালন
ফকিরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়নি। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে
যাবার আগেই ফকির দেহরক্ষা করেছিলেন ।
শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সম্বন্ধে আরও কয়েকটি তথ্য পাওয়া যায়
সৈয়দ সাহেবের প্রবন্ধে । সৈয়দ সাহেব লিখেছেন £
“রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-কীতির একটি শ্রেষ্ঠ অংশ
হ$ রবীন্দ্রনাথ
, গশিলাইদহের কুঠিবাড়িতে, পদ্মা ও গড়াই নদীর বক্ষে রচিত
হয়েছে । কবির প্রথম যৌবনের ছোটগল্পের জন্মস্থান শিলাইদহ ।
কবি যখন শিলাইদহে আসেন তখন পাঁচ পুত্রকন্যাই জীবিত।
হার দাম্পত্য-জীবনের এক মধুময় অংশ কাটে শিলাইদহে ।**.
( তাছাড়। ) এখানেই তিনি বাউল ও সাধকদের সঙ্গে অস্তরঙ্গ-
ভাবে মেলামেশার সুযোগ পান ও বাংলার পল্লী-্বদায়র ও
মরমী কবিদের অন্তরের কথা অনুধাবন করতে সক্ষম হন।
***সোনার তরী (১২৯৮ বাংলা); মানসন্থদ্দরী (১২৯৯
বাংল! ), উর্বশী (১৩১২ বাংলা ). চিত্রা, ক্ষণিকা, গীতাঞুলি
ও গীতিমাল্যের অনেক কবিতা ও গান শিলাইদহে রচিভ
হয়েছিল ।
রবীন্দ্রনাথের অনেক ছোটগল্পের বিষয়বস্তু শিলাইদহ
অঞ্চলের সংঘটিত ঘটনা! থেকে নেওয়। হয়েছে । তার ছোটগল্প
“জীবিত ও মৃত"-র ভিত্তি শিলাইদহের একটি সত্য ঘটন]।
“ঝোষ্টমী' গল্পের আখ্যানবস্তব সর্কক্ষেপী নামক এক স্থানীয়
বৈষ্ুবীর জীবন থেকে ধার করা ।”
সৈয়দ সাহেবের প্রবন্ধ থেকে শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সম্বন্ধে আরও
যে সব অমূল্য তথ্য পাওয়া যায় তা হলো, ওই কুঠিবাড়িতে দীনবন্ধ
এনডুজ (0. ঢু, £100155/5 ) কিছুকাল কবির সঙ্গে বাস করে
গেছেন । কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যখন কুষ্টিয়ার হাকিম তখন তিনি
প্রায়ই কুঠিবাঁড়িতে এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ-আলোচন!
করতেন। এছাড়া, আচার্য জগদীশচন্দ্র, সাহিত্যিক বীরবল (প্রমথ
চৌধুরী), নাটোরের মহারাজ! জগদীন্দ্রনাথ রায়, কবি-বন্ধ
লোকেন্দ্রনাথ পালিত (1. ০. ১.) এবং কবি-ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ
ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথও ওখানে এসে কবির সঙ্গে বাস করে গেছেন।
ঠাকুর পরিবারের জমিদারী যখন ভাগ হয় তখন ওই কুঠিবাড়িটি
-পড়ে কবির ভ্রাতুলপুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (সত্যেন্্রনাথের পুত্র) ভাগে ।
রবীন্দ্রনাথ ২৫
এর পর ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে ভাগ্যকুলের জমিদার শ্ঠামারঙ্গিনী রায়চৌধুরী
হ্বরেন্্নাথের জমিদারী বন্ধকীন্ুত্রে হাইকোর্টের নিলামে খরিদ করে
নেন। পরবর্তীকালে, অর্থাৎ ১৯৫২ খ্রীষ্টাৰে পূর্ববঙ্গ জমিদারী-দখল
আইন'এর বলে ঠাকুর পরিবারের জমিদারীটি পাঁকিস্তান সরকারের
দখলে আসে। কিন্তু শিলাইদহের কুঠিবাঁড়িটি ভাগ্যকুলের জমিদারদের
পারিবারিক বাসম্থানরূপে তাদের হাতেই থেকে যায়।
এর পর ১৯৫৭ স্রীষ্টাব্দে পাক সরকার 'পূরাকীতি সংরক্ষণ আইন”
(:00121076 100010216 01655058008 4১০০) অনুসারে উক্ত
কুঠিবাড়িটি দখল করে নিয়ে গৌরবময় স্মৃতিগীঠ হিসেবে সংরক্ষিত বলে
ঘোষণা করেন।
রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন সরকারী শিক্ষানীতিতে বিশ্বীসী ছিলেন না ॥
ভা তিনি যখন শিলাইদহে ছিলেন, তখন তার ছেলেমেয়েদের লেখা-
পড়া শেখানোর ভার নিজের হাতে গ্রহণ করেন। কিন্তু তার পক্ষে
সব সময় ছেলেমেয়েদের পড়ানে। সম্ভব হতো না বলে তিনি তার
সাহায্যকারী শিক্ষক হিসেবে লরেন্স সাহেব ও পণ্ডিত শিবেন বিদ্ভার্ণব
মহাশয়কে নিযুক্ত করেছিলেন। লরেন্স সাহেব পড়াতেন ইংরেজী এবং
পণ্তিতমশাই পড়াতেন সংস্কৃত ।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, নিজের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের
পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতেই তার মনে একটি আদর্শ শিক্ষা নিকেতন
স্থাপনের বাসনা জাগে । এবং সেই বাসনারই প্রতিফলন হিসেবে
স্থাপিত হয় শান্তিনিকেতন” ।
আগেই বলেছি যে, শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে যাবার , পরেই
রবীন্দ্রনাথ পল্লীৰাংলার সঙ্গে পরিচিত হন। পল্লীবাসীদের ছুঃখ-
দুর্দশার স'ঙ্গ তার পরিচয় ঘটে এই সময়েই । তাদের অশিক্ষা। হুঃখ-কষ্ট
কবির মনকে কিভাবে নাড়া দিয়েছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় তীর
নিজের লেখ! থেকেই। তিনি লিখেছেন £
৯৬৬,
রবীন্দ্রনাথ
“যখন গ্রামের চারিদিকের জঙ্গলগুলেো জলে ডুবে পাতা-
লতা-গুল্ম পচতে থাকে, গোয়ালঘর ও লোকালয়ের বিবিধ
আবর্জনা চারিদিকে ভেসে বেড়ায়, পাট পচানোর গন্ধে
বাতাস ভারাক্রাস্ত, উলঙ্গ পেট-মোটা৷ প।-সরু রুগ্ন ছেলেমেয়ের!
যেখানে সেখানে জল-কাদাঁয় মাখামাখি ঝাঁপাঝাপি করতে
থাকে, মশার ঝণক স্থির জলের উপরে একটি বাম্পস্তরের মতো
ঝাঁক বেঁধে ভেসে বেড়ায়, গৃহস্থ মেয়ের! ভিজে শাড়ি গায়ে
জড়িয়ে বাদলের ঠাণ্ড। হাওয়ায় বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে
হাটুর ওপর কাপড় তুলে ঠেলে ঠেলে সহিষ্ণু জন্তর মত ঘরকন্নার
নিত্যকর্ম করে যায় তখন সে-্দৃশ্ট কোনমতেই ভাল লাগে
না। ঘরে ঘরে বাত ধরেছে, পিলেওয়াল৷ ছেলেরা অবিশ্রাম
কাদছে, কিছুতেই কেউ তাদের বাঁচাতে পারছে না--এত
অবহেলা, অন্বাস্থ্য, অসৌন্দর্য, দারিদ্র্য মানুষের বাসস্থান কি
এক মুহুর্ত সহ হয়! সকল রকম শক্তির কাছেই আমরা হাল
ছেড়ে দ্রিয়ে বসে আছি। প্রকৃতি উপদ্রব করে তাও সই,
শান্তর চিরদিন ধরে যে-সকল উপদ্রব করে আসছে তার বিরুদ্ধেও
কথাটি বলতে সাহস হয় না।” [ ছিন্নপত্র ]
এই সব গরাব মানুষের ছুঃখ-কষ্ট দেখে কবির মন কিভাৰে কেঁদে
উঠেছিল, তার পরিচয়ও পাওয়া যায় তার লেখা থেকেই । তিনি
লিখেছেন £
০০০০০ পল্লীর হঃখ-দেম্ত আমার কাছে স্বস্পষ্ট হয়ে
উঠল, তার জন্যে কিছু করব এই আকাজ্ষায় আমার মন
ছটফট করে উঠেছিল। তখন আমি যে জমিদারী ব্যবসায়
করি, নিজের আয়-ব্যয় নিয়ে ব্যস্ত, কেবল বণিকশবৃত্তি করে
দিন কাটাই, এট! নিতান্তই লজ্জার বিষয় বলে মনে হয়েছিল ।
তার পর থেকে চেষ্টা করতুম--কী করলে এদের মনের
উদ্বোধন হয়, আপনাদের দায়িত্ব এরা আপনি নিতে পারে,
রবীন্দ্রনাথ ২৭
আমরা যদি বাইরে থেকে সাহায্য করি তাতে এদের অনিষ্টই
হবে, এই প্রশ্নই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। এদের উপকান্প
করা শক্ত, কারণ এরা নিজেকে বড় অশ্রদ্ধা করে 1”
[ পল্লী-প্রকৃতি ]
শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে বসেই রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন
যে, “মানুষের সঙ্গে মানুষের কোন ধর্মগত ও বর্ণগত বৈষম্য নেই, সেটা
শুধু মানুষেরই জাগতিক স্বার্থে রচিত। মানবাত্মার মধ্য দিয়েই
পরমাত্বার স্বরূপ অনুভব করা যায়। মন্দিরে, মসজিদে, গীর্জায় দেবতা
নেই, আছেন মানুষের মধ্যে, জীবনের সাধনার মধ্যে 1”
॥ নোবেল প্রাইজ লাভ এবং তারপর ॥
১৩১৮ সালের পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের বয়স পঞ্চাশ বছর পূর্ণ
হয়। এই উপলক্ষে “বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কলকাতার টাউন হলে
সর্বপ্রথম “রবীন্দ্র জয়ন্তী” অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। টাউন হলে ওই
দিন এক বিরাট সভা হয়। সেই সভায় “বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ"
দেশবাসীর পক্ষ হতে রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন ।
এর কয়েকদিন পরেই রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা যাঁন। ওখানে তিনি
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অন্ুরুদ্ধ হয়ে অনেকগুলি বক্তৃতা করেন।
আমেরিকায় মাস্ ছয়েক থেকে আবার তিনি ইংল্যাণ্ডে গেলেন।
ইতিমধ্যে ইংল্যাণ্ড হতে 'ীতাঞ্জলি'-র ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত
হয়েছে । এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সারা ইংল্যাণ্ডে
রবীন্দ্রনাথের নাম ছড়িয়ে পড়লো । ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশের
কবি ও সাহিত্য-সমালোচকর। কবি রবীন্দ্রনাথকে এবং তার লেখা
গীতাঞ্চলিঃকে সাদর অভিনন্দন জানালেন ।
২৮ রবীন্দ্রনাথ
এই সময় লগ্ুনে অনেকগুলি সভায় তাকে সম্বর্ধনা জানানো
হয়েছে । সেই সব সম্বর্ধনা! সভায় অনেক বক্তা এ-কথাও বলেন যে,
এমন মহৎ ভাবের কবিতা ইংরেজী ভামায় এর আগে আর কখনো
রচিত হয়নি ।
গীতাঞ্জলির প্রশংসা ইংল্যাণ্ড হতে ইয়োরোপের অন্যান্য দেশেও
ছড়িয়ে পড়লো । এর পর বইটি যখন সুইডেনের নোবেল কমিটির
কাছে পেশ কর! হলো! তখন 'স্থইডিস আকাডেমি'র স্ভ্যরা বইটি পড়ে
রবীন্দ্রনাথকে পৃথিবীর মহত্তম কবি হিসেবে মেনে নিয়ে তাকে “নোবেল
প্রাইজ' দিয়ে সম্মানিত করলেন।
রবীন্দ্রনাথের এই সম্মানলাভে উৎফুল্ল হয়ে কবি অভুলপ্রসাদ
তার বিখ্যাত কবিতা “আ৷ মরি বাংলা ভাষা'-য় লিখলেন £
“বাজিয়ে রবি তোমার বীণে,
আনলে মাল! জগৎ জিনে |”
ছন্দের যাহকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখলেন 2
“রবির অর্ধ্য পাঠায়েছে আজ
প্রবতারার প্রতিবাসী,
প্রতিভার এই পুণ্য পূজায়
সপ্তসাগর মিলল আসি।
কোথায় শ্যামল বঙ্গভূমি,_
কোথায় শুভ্র তুষারপুরী-_
কি স্তরে মিলল তবু,
অন্তরে কে টানল ডুরি !
কোলাকুলি কালায় গোরায়
প্রাণের ধারায় প্রাণ মেশে
রাজার পূজা! আপন রাজ্যে
কবির পূজা দেশে দেশে ।”
এদিকে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে নোবেল পুরস্কার
রবীন্দ্রনাথ ২৯
পেয়েছেন দেখে ভারতের তৎকালীন ইংরেজ্ছ সরকারের বোধ হয় মনে
হলে! যে, কবিকে সরকারের পক্ষ থেকেও একটা খেতাব-টের্তাৰ
দেওয়া! দরকার, নইলে বিশ্বৰ্বাসীর কাছে সরকার হাস্তাস্পদ হবে ।
এই কথা ভেবেই ভারত সরকার রবীন্দ্রনাথকে "স্যার" উপাধি দিয়ে
প্রমাণ করতে চাইলেন যে, গুণীজনের ্বীকৃতি সরকার দিয়ে থাকেন।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে এই সরকারী খেতাবের মূল্য যে
কানাকড়ির চেয়ে বেশি নয় তার প্রমাণ পেতেও দেরি হলো না
ইংরেজ সরকারের ।
সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকার তখন ভারতের বুকে চালাচ্ছে
ত্রাসের রাজত্ব। ওদের সেই অ-শাসন আর কু-শাসনের বিকদ্ধে
সার! ভারতবর্ষ তখন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে । এই সময় অর্থাৎ ১৯১৯
খীষ্টাব্ের ১৩ই এপ্রিল তারিখে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে
একটি প্রতিবাদ সভা আহ্বান কর! হয়। কথ! ছিল যে, পাধ্াব-কেশরী
লাল। লাজপৎ রায় সেই সভায় বক্তৃতা করবেন । এ বক্তৃতা যে ইংরেজ
শ[সনের বিরুদ্ধে হবে তা বুঝতে দেরি হয় না পাঞ্জাব সরকারের । তাই
পাঞ্জাবের গভন্নর ভায়ারের নির্দেশে রাইফেল আর মেসিনগানধারী
সৈম্ত-সামন্ত নিয়ে ওখানে হাজির হয় জেনারেল ও'ডায়ার ।
জালিয়ানওয়ালাবাগে তখন হাজার হাজার নরনারী সমবেত
হয়েছে লালাজীর বক্তৃতা শোনবার জন্যে ৷ ঠিক এই সময়েই জেনারেল
ও'ডায়ার তার সেনাবাহিনী নিয়ে সেখানে হাজির হয়ে নিবিচারে
গুলিবর্ষণ শুর করে। এ আক্রমণ এমনই বীভৎস যে, ঘটনাস্থলেই
তিনশ উনআশিজন নরনারী নিহত হয় এবং অগণিত নরনারী
গুরুতররূপে আহত হয়।
রবীন্দ্রনাথ সে সময় শান্তিনিকেতনে ছিলেন। পরদিন তিনি
যখন সংবাদপত্রে এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পড়লেন, তখন
* তখন শান্তিনিকেতনে স্থাপিত হয়েছে এবং রবীন্দ্রনাথ তাকে আদশ
শিক্ষায়তন হিসেবে গড়ে তুলবার জন্তে নিজেই তার ভার নিয়েছেন।
৩৬ রবীন্দ্রনাথ
শোকে ছুঃখে আর মর্মবেদনায় তাঁর মনটা উদ্বেলিত হয়ে উঠলো । তিনি
তখন চিন্তা করতে লাগলেন, কিভাবে এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের
প্রতিবাদ জানানো যায়। পন্থা স্থির হতে দেরি হলো না।
শান্তিনিকেতন হতে কলকাতায় ফিরে এসে তিনি ভাইসরয়কে
একখানি চিঠি লিখে তার দেওয়া "স্তার উপাধিটি বর্জন করলেন।
এই প্রসঙ্গে কবি তার শুভান্ুধ্যায়ীকে যে চিঠিখানি লিখেছিলেন
তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । তিনি লিখেছিলেন ঃ
“কলকাতায় এসে বড়লাটকে চিঠি লিখেছি_ আমার এ
ছার' (51৫) পদবীট! ফিরিয়ে নিতে । "আমি বলেছি,
বুকের মধ্যে অনেক ব্যথা জমে উঠেছিল, তার ভার আমার
পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠেছে। তাই এ ভারের উপরে আমার
এ উপাধির ভার আর বহন করতে পারছিনে ॥»
মে আমলে ইংরেজ সরকার-প্রদন্ত খেতাবধারীরা নিজেদের
কেউকেটা বলে মনে করতেন। ইংরেজ সরকার তাদের বশংবদ বড়-
লোকদের ভেতর থেকে অধিকতর বশংবদ ব্যক্তিদের বাছাই করে প্রতি
বছর পয়ল! জানুয়ারী তারিখে রায় সাহেব, খান সাহেব, রায় বাহাছুর,
খান বাহাছুর প্রভৃতি উপাধি দিয়ে তাদের আরও বশীতৃত করতেন।
আবার সমাজে ধারা সুপ্রতিষ্ঠিত এবং কারঞ্চন-কৌলিন্যে মুখ্য কুলীন,
তাদের মধ্যে কিছু কিছু লোককে বস্তার” উপাধি দ্রিয়ে জনসাধারণ থেকে
তাদের আলাদা করে রাখা হতো। এবং এরাও ওই সব উপাধি-গর্বে
গবিত হয়ে ধরাকে সরা এবং ইংরেজকে প্রভূ মনে করে ইংরেজের
স্বার্থ রক্ষা করে চলতেন। রবীন্দ্রনাথকেও হয়তো ওঁরা তেমনি একজন
স্তাবক করতে পারবেন বলে আশা করেছিলেন ; কিন্তু মে আশা-
তরুর মূলে রবীন্দ্রনাথ তার পত্ররূগী কুঠারাঘাত করে জানিয়ে দিলেন
ষে, রবীন্দ্রনাথকে ওরা যা ভেবেছিল তিনি তা নন।
॥ প্রাচ্য ও পাশ্চান্তের দেশে দেশে ॥
কয়েক বছর পরের কথা। কবির কাছে নিমন্ত্রণ পত্র এলো
অক্সফোর্ড হতে। অক্ফোর্ডে হিবার্ট লেকচার দিতে হবে তাকে ।
বছর ছয়েক আগেও একবার সেখান থেকে নিমন্ত্রণ এসেছিল । কিন্ত
সে-বার অন্ুস্থতার জন্তে তিনি সে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি ।
এবার তিনি দলবলসহ যাত্রা! করলেন।
ইংল্যান্ডে না গিয়ে প্রথমেই তিনি গেলেন ফ্রান্সে। ফান্সের
রাজধানী প্যারিস শহরে তিনি তার নিজের হাতে আকা! ছবিগুলির
একটি প্রদর্শনী করেন। সে-সব ছবি দেখে চিত্ররসিক সমাজ এবং
শিল্প-সমালোচকর! যথেষ্ট প্রশংসা করলেন কবির শিল্প-প্রতিভার ।
প্যারী হতে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যাণ্ডে এলেন। ওখানে পৌছবার
কয়েকদিন পরেই “মানবধর্ম সম্বন্ধে অক্সফোর্ডে এক বক্তৃতা দিলেন ।
তারপর এ একই বিষয়ে আরও ছু'বার বক্তুত। দিলেন তিনি ।
অক্সফোর্ডে বক্তৃতা দেবার পরে রবীন্দ্রনাথ জার্মীনীতে গেলেন।
জার্মানীব বালিন শহরে মনম্বী বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে তার
পরিচয় হয়। বালিনে কিছুদিন থেকে তিনি গেলেন জেনেভায় ।
তারপর রাশিয়ায়।* রাশিয়া দেখে তার মনে একটা নতুন চেতনার
স্থত্টি হলো । এই নবচেতনার কথা তিনি লিখে জানালেন প্রতিমা
দেবীকে । কবি লিখলেন £
«.**বহুকাল থেকেই আশা করেছিলুম, আমাদের
জমিদারী যেন আমাদের প্রজাদেরই জমিদারী হয়_ আমরা
*রাশিয়া সম্বদ্ধে কবি আরও অনেক বিষয় লিখে গেছেন। তাব সে-সব
ব্রচনা একত্রিত হয়ে রাশিয়ার চিঠি' নামে প্রকাশিত হযেছে । পাঠক-পাঠিকা
এ বিষয়ে ভ।লভাবে জানতে চাইলে রবীন্দ্রনাথের 'বাশিয়ার চিঠি" নামক
্রইখান। পড়ে নিতে পারেন ।
৩২ রবীন্দ্রনাথ
যেন ট্রা্টির মতো থাকি। অল্প কিছু খোরাক-পোষাক
দাবি করতে পারব, কিন্তু সে ওদেরই অংশীদারের মত। কিন্ত
দিনে দিনে দেখলুম জমিদারীর রথ সে রাস্তায় গেল না।
"আর একবার আমার বহুদিনের আশা পূর্ণ করবার আশা
করব |
রাশিয়ায় কিছুদিন বাস করে কবি আমেরিকায় গেলেন । সেখানে
প্রায় তিন মাস যাবৎ নান! অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়ে আবার তিনি ফিরে
এলেন লগ্তনে। কিছুদিন সেখানে থেকে ১৯৩১ শ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি
মাসে আবার তিনি দেশে ফিরে এলেন ।
রবীন্দ্রনাথ ইয়োরোপ ভ্রমণ সেরে দেশে ফিরে আসবার কিছুদিন
পরেই হিজলী বন্দীশালায় এমন একটি কাণ্ড ঘটে, যার ফলে সারা দেশ
চঞ্চল হয়ে ওঠে । কয়েকজন বাঙালী যুবককে তখন রাঁজবন্দী হিসেবে
হিজলী জেলে আটক রাখা হয়েছিল। এদের মধ্যে কয়েকজনের
সঙ্গে জেলখানার ওয়ার্ডারদের বিরোধ বাধে। ওয়ার্ডারর তখন ওই
যুবকদের শায়েস্তা করবার জন্যে মতলব আটতে থাকে । এর কয়েক
দিন পরেই হঠাৎ বিন! প্ররোচনায় ওয়ার্ডাররা বিপদ সংকেতম্চক
হুইসেল বাজিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বেজে ওঠে “পাগল৷ ঘণ্টা ॥
জেলখানার নিয়ম অনুসারে কোন ওয়ার্ডার বা অফিসার রাইফেল
নিয়ে জেলের ভেতরে যেতে পারে না! ; তবে পাগল। ঘণ্টার ( 4১12107
7361) ) সময় এ নিয়মের ব্যতিক্রম হতে পারে । তখন হাবিলদারের
নেতৃত্বে রাইফেলধারী ওয়ার্ডাররা জেলখানাব ভেতরে প্রবেশ করতে
পারে এবং দরকার বোধ করলে গুলিও চালাতে পারে।
তাই 'পাগলা ঘণ্টা, বেজে উঠতেই জেলারের গোপন নির্দেশে
হাবিলদার একদল সশস্ত্র ওয়ার্ডারকে জেলখানার ভেতরে নিয়ে গিয়ে
ছ'জন রাজবন্দীকে গুলি করে হত্যা করে এবং নির্মমভাবে লাঠি চার্জ
করে অনেক রাজবন্দীকে গুরুতরভাবে আহত করে।
রবীন্দ্রনাথ ৩৩
নিরস্ত্র এবং অসহায় রাজবন্দীদের ওপর এই রকম কাপুরুষো্চিত
আক্রমণের প্রতিবাদে কলকাতার মনুমেণ্ট ময়দানে একটি বিরাট
জনসভা হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ । সভাপতির
ভাষণে তিনি সেদিন ইংরেজ সরকারকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন 2
“আমি আমার স্বদেশবাসীর হয়ে রাজপুরুষদের এই বলে
সতর্ক করতে চাই যে, বিদেশী রাজা যতই পরাক্রমশালী হোক
না কেন, আত্মসন্মান হারানো তার পক্ষে সকলের চেয়ে
দুর্বলতার কারণ । প্রজাকে পীড়ন স্বীকার করে নিতে বাধ্য করা
রাজার পক্ষে কঠিন না হতে পারে, কিন্তু বিধিদত্ত অধিকার
নিয়ে প্রজার মন যখন ব্বয়ং রাজাকে বিচার করে তখন তাকে
নিরস্ত করতে পারে কোন্ শক্তি? একথ৷ ভুললে চলবে না
যে, প্রজাদের অনুকুল বিচার ও আন্তরিক সমর্থনের 'পরেই
অবশেষে বিদেশী শাসনের স্থায়িত্ব নির্ভর করে ।৮
এই সভা অনুষ্ঠিত হবার পর রবীন্দ্রনাথ আবার শাস্তিনিকেতনে
চলে গেলেন। কারণ সেখানে তার তখন অনেক কাজ ।
কয়েক বছর পরে কবির কাছে পারস্তরাজের কাছ থেকে নিমন্ত্রণ
এলো । রবীন্দ্রনাথের বয়ন তখন সত্তর পার হয়ে গেছে। তিনি
তাই যাবেন কি যাবেন না৷ এই কথা চিন্তা করতে লাগলেন ।
এদিকে কবির পাশা বন্ধু দিনসা! ইরানী তখন জানতে পেরেছেন
যে, পারস্ঠরাজ কবিকে পরারস্তে যাবার জন্তে সনির্বন্ধ অন্থুরোধ
জানিয়েছেন । দিনস। ইরানী তখন কবিকে একখানি পত্র লিখে তাকে
পারস্তে যাবার জন্তে বিশেষভাবে অনুরোধ জানালেন। ওই পত্রে
তিনি আরও লিখলেন যে, পারস্তের বুশেয়ার বন্দর হতে তিনিও কবির
সাথী হবেন। কবি তখন পারস্তরাজকে জানিয়ে দিলেন ষে, তিনি
পারস্তে যেতে রাজী আছেন। শুর হলো পারন্যযাত্রার প্রস্ততি ।
পারস্য সরকারের পক্ষ হতে কবিকে জানিয়ে দেওয়া হলে যে, তাকে
৩৪ রবীন্দ্রনাথ
বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হবে এবং ১১ই এপ্রিল (১৯৩২) তারিখে
দমদম বিমানবন্দর হতে তার জন্যে নির্দিষ্ট বিমানটি পারস্য অভিমুখে
যাত্র করবে
নির্দিষ্ট দিনে এবং নির্দিষ্ট সময়ে দমদম বিমানবন্দর হতে বিমানটি
পারস্ত অভিমুখে যাত্র! করে এবং পরদিন, অর্থাৎ ১৩ই এপ্রিল কবিকে
বুশেয়ার বন্দরে নামিয়ে দেয়। কবি-বন্ধু দিনস! ইরানী ওখানে আগে
থেকেই কবির জন্যে অপেক্ষা করছিলেন । কবি বিমামবন্দরে অবতরণ
করলে তিনি এগিয়ে এসে তার সঙ্গে দেখা করলেন ।
বুশেয়ার হতে কবিকে মোটরে করে ফিরোজ শহরে নিয়ে যাওয়া
হয় এবং এক বিরাট জনসভায় কবিকে নাগরিক সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা
হয়। ফিরোজে কয়েকদিন থেকে কবি গেলেন ইস্পাহানে। সেখান
থেকে তেহেরাণে। তেহেরাণেই পারস্তরাজ রেজা শাহ পহুলবীর সঙ্গে
কবির সাক্ষাৎ হয়।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কবির একাত্তর বংসরের জন্মদিনের
উৎসবও তেহেরাণে অনুষ্ঠিত হয়।
পারন্ত ভ্রমণ শেষ হবার আগেই ইরাকের শাহ'র কাছ থেকে
ইরাক ভ্রমণের জন্তে নিমন্ত্রণ পত্র এলো রবীন্দ্রনাথের কাছে । এই
নিমন্ত্রণ-পত্র পেয়ে কবি ৫ই মে তারিখে তেহেরাণ হতে মোটরে
বোগদাদ অভিমুখে যাত্র। করলেন ।
তেহেরাণের মত বোগদাদেও তাকে মহাসমাদরে আপ্যায়ন করা
হয়। বোগদাদে কবিকে যে অভিনন্দন জ্ঞাপন কর! হয় তার উত্তরে
তিনি ভারতবর্ষে সান্প্রদায়িক বিদ্বেষ দূর করবার ব্যাপারে বোগদাদের
মুসলমান সমাজের সহযোগিতা কামনা করেন ।
বোগদাদে কয়েকদিন কাটিয়ে ওরা জুন তারিখে (১৯৩২)
রবীন্দ্রনাথ আবার কলকাতায় ফিরে এলেন।
॥ ভারত-ভ্রমণ ॥
বিদেশ ভ্রমণ শেষ হবার পবে কিছুকাল শান্তিনিকেতনে এবং
কলকাতায় থেকে ভাবত-ভ্রমণ শুক করলেন রবীন্দ্রনাথ ।
প্রথমেই গেলেন বোম্বাই শহরে । সেখানে তখন “রবীন্দ্র-সপ্তাহ'-ব
অনুষ্ঠান চলছিল । তখন ১৯৫৪ খ্রীষ্টাব্দে এপ্রিল মাস। কবিব
সঙ্গে শান্তিনিকেতনেব কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীও গিয়েছিলেন । তাব!
সেখানে “তাসের ঘর' আর "শাপমোচন? অভিনয় করলেন ।
বোম্বাই হতে কবি গেলেন ওয়ালটেয়ারে । সেখানে গিয়ে
তিনি অন্ধ, বিশ্ববিগ্ভালয়ে বক্তৃতা দ্রিলেন। এব পর তিনি গেলেন
হায়দরাবাদে । হায়দবাবাদ তখন নিজাম-শাসিত দেশীয় বাজ্য
(190৮০ 5980 )। এরাজ্যের অধিবাসীদের শতকর। নববই ভাগ
হিন্দু আর শতকরা দশ ভাগ মুসলমান ।
হায়দরাবাদেও কবিকে বিপুলভাবে সম্বর্ধনা করা হয়।
নিজামের অতিথিরপে হায়দরাবাদে দেড় মাস থেকে আবার
তিনি ফিরে এলেন কলকাতায় ।
কলকাত৷ শহরে তখন রামমোহন শতবাধিকী উৎসবের অনুষ্ঠান
চলছিল। সেই অনুষ্ঠানে কবি একদিন, তার লিখিত ভাষণ পাঠ
করলেন। এর কয়েকদিন পরেই তিনি 'শাস্তিনিকেতন'-এ ফিরে
গেলেন।
কবির বয়স তখন তিয়াত্তর পার হয়ে চুয়াত্তরে পড়েছে । কিন্ত
এই বয়সেও 'শ্বীস্তিনিকেতন'-এর জন্যে অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করে
চলেছেন তিনি। তার একমাত্র উদ্দেশ্য, “শাস্তিনিকেতন'কে তিনি
যথার্থ শান্তিনিকেতন করে গড়বেনই। কিন্ত গড়বার উদ্দেশ্য
থাকলেও হাতে ভীর টাকা ছিল না। তাই তিনি একদল ছাত্র-ছাত্রী
৬৬ রবীন্দ্রনাথ
নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন অর্থসংগ্রহের আশায়। ছাত্রছাত্রীদের ছারা
অভিনয় করিয়ে অর্থসংগ্রহ করবেন, এই উদ্দেশ্যেই বৃদ্ধ বয়সে কবি
আবার বেরিয়ে পড়লেন ।
প্রথমেই তিনি গেলেন সিংহলে । সেখান থেকে ফিরবার সময়
মাদ্রাজে নামবার ইচ্ছা ছিল তার; কিন্ত নানা কারণে সেবার আর
মাদ্রীজে নাম! হলো না।
এর পর পুজোর ছুটিতে তিনি মাদ্রাজ রওনা! হলেন। মাঁদ্রাজে
'শাপমোচন' অভিনয় হলো । ওখানকার কয়েকটি সভায় বক্তৃতা
করলেন তিনি; কিন্তু অন্যান্য জায়গায় কবির আগমনে যে রকম
উৎসাহ ও উদ্দীপন! দেখা গিয়েছিল মাদ্রাজে তেমন কিছু হলো না।
তিনি তাই কিছুটা ক্ষুগ্রমনেই 'শাস্তিনিকেতন'-এ ফিরে এলেন।
এর পর ( ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে) কাশী বিশ্ববিষ্ভালয়
(বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি এব পক্ষ থেকে পণ্ডিত মদনমোহন
মালব্য রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানালেন সেখানকার সমাবর্তন উৎসবে
যোগদান করবার জন্যে । মালব্যজীর নিমন্ত্রণ খুশীমনেই গ্রহণ করলেন
রবীন্দ্রনাথ । যথাসময়েই তিনি উপস্থিত হলেন সেখানে । কাশী
বিশ্ববি্ভালয় সেবার রবীন্দ্রনাথকে "ড্র উপাধি দিয়ে সম্মানিত
করলেন।
কাশী হতে রবীন্দ্রনাথ গেলেন লক্ষৌ। সেখানে দিন পনের
কাটিয়ে আবার তিনি শাস্তিনিকতনে ফিরে এলেন ।
শীস্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের জন্তে তখন শ্যামলী” নামে একটি
মাটির ঘর তৈরী হয়েছে । কবির ইচ্ছান্ুসারেই এটা হয়েছে । কবি
খুশীমনে সেই মাটির ঘরে বাস করতে লাগলেন:
দেখতে দেখতে এসে গেল এপ্রিল মাস। কবির বয়স চুয়াত্তর
পেরিয়ে পঁচান্তরে পড়লো । কয়েকদিন পরেই শুর হলো কবির
জন্মবার্ষিকী উৎসব । সে-বারের উৎসবে পরশুরাম রচিত “বিরিধি”-
বাবা গল্পটিকে নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় করেন ছাত্র-ছাত্রীরা ৷
রবীন্দ্রনাথ ৩,
ওই দিনেই কবির নতুন কাব্যগ্রন্থ “শেষ সন্ধ্যা প্রকাশিত হলো ।
তখন গ্রীষ্মের ছুটি থাকায় রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এসে কিছুদিন
গঙ্গার বুকে বোটে বাস করেন। বোটে বসেও তিনি আলম্তে
সময় কাঁটাননি ৷ গঙ্গাবঙ্ষের স্নিগ্ধ হাওয়ায় বোটের পাটাতনে বসে
তিনি একের পর এক কবিতা লিখতে লাগলেন ।
ছুটি শেষ হলে আবার তিনি ফিরে গেলেন 'শাস্তিনিকেতন*-এ।
এদিকে শাস্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর আধিক অবস্থা তখন
রীতিমত শোচনীয় হয়ে পড়েছে । অবস্থা এমন যে, দৈনন্দিন খরচ
চালানোই দায় হয়ে উঠেছে । কবি তখন আবার বের হলেন ছাত্র-
ছাত্রীদের নিয়ে । এবারে তিনি “চিত্রাঙ্গদা' অভিনয়ের জন্তে প্রস্ত
হয়ে গেলেন । ৰ
ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই গেলেন পাটনায়।
সেখানে “চিত্রাঙ্গদা” অভিনয় বেশ ভালই জমলো। কিছু টাকাও
পেলেন কবি। কিন্তু যতটা আশা করেছিলেন, ততটা পেলেন না।
পাটন। থেকে তিনি গেলেন এলাহাবাদে । সেখানেও “চিত্রাঙ্গদা,
অভিনীত হলো'। কিছু টাকাও পেলেন ।
এর পর তিনি গেলেন লাহোরে । সেখানেও “চিত্রাঙ্গদা' অভিনীত
হয় এবং কিছু টাকা তার হাতে আসে। কিন্তু বিশ্বভারতীর দেনা তখন
ষাট হাজার টাকা ; তার সামান্তম ভগ্লাংশও তার হাতে আসেনি
তখন।
ব্যাপার দেখে কিছুটা হতাশ হয়ে অবশেষে তিনি দিল্লীতে গেলেন।
দিল্লী রাজধানী শহর । রবীন্দ্রনাথের আশ! যে, ওখানে হয়তে। কিছু
বেশী টাক! তিনি পাবেন ।
গান্ধিজী তখন দিল্লীতে ছিলেন। তিনি কবির সঙ্গে দেখা করলে
কবি ভার কাছ্ছে অকপটে তার অর্থকুচ্ছতার কথ জানালেন । তিনি
বললেন যে, ইতিমধ্যেই বিশ্বভারতীর জন্তে বাট হাজার টাকা খণ
করতে হয়েছে তাকে ।
নু
মদে রবীন্দ্রনাথ
কবির কাছ থেকে এই কথা শুনে গান্ধিজী নিজে উদ্যোগী হয়ে বাট
হখজার টাকা সংগ্রহ করে কবিকে দিলেন। কৰি তখন ব্বস্তির নিঃশ্বাস
ফেলে শাস্তিনিকেতন-এ ফিরে এলেন ।
॥ শেষজীবন ॥
১৯৩৮ গ্রীষ্টাব্ধের মে মাস। কবির বয়স তখন আটাত্বরে পড়েছে।
সেবারের জন্মবাধিকী অনুষ্ঠিত হলো কালিম্পং শহরে ৷ কাবণ, গরমের
জন্যে কবি তখন কালিম্পং-এ ছিলেন।
কালিম্পং হতে কৰি গেলেন মংগুতে । সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে
আবার গেলেন কালিম্পডে।
রবি তখন অস্তাচলগামী । দেহটা ক্রমশঃ অচল হয়ে আসছে।
কবি বেশ বুঝতে পাবছেন ষে, তার শেষের দিন এগিয়ে আসছে।
কিন্তু তবুও লেখার বিরাম নেই। কালিম্পডে বসে তিনি তখন
লিখছেন “বাংল! ভাষ! পবিচয়", এবং তারই ফাকে ফাকে চলছে
কবিতা লেখা ।
কিছুদিন মংপু আর কালিম্পঙে থেকে আবার তিনি ফিরে এলেন
শান্তিনিকেতনে । সেবার আব পুজার ছুটিতে কোথাও গেলেন না ।
ঘরে বসে লিখতে লাগলেন প্রবন্ধ আর কবিতা ।
১৯৩৯ খ্রীষ্টাকের জানুয়ারী মাসে জওহরল।ল এলেন “হিন্দী ভবন"
এর দ্বারোদঘাটন করতে । দৈবচক্রে সুভাষচন্দ্র সেই সময় শাস্তি-
নিকেতনে উপস্থিত হলেন। তিনি তখন কংগ্রেসের সভাপতি ।
কলকাতা শহরে তিনি একটি ভবন তৈরি করবার জন্যে সেন্টাল
আভিনিউ-এ একখণ্ড জমি একশ' বছরের জন্যে লীজ নিয়েছিলেন
কলকাতা কর্পোরেশনের কাছ থেকে । কর্পোরেশন বাধিক এক টাকা
রবীন্দ্রনাথ ৩৯
খাজনায় ওই জমিটা লীজ দেন স্ুভাষচন্দ্রকে। ওই জমিতে তার
প্রস্তাবিত ভবনের ভিত্তি স্থাপনের জঙন্টে সুভাষচন্দ্র অন্ুরোধ করলেন
কবিকে । সঙ্গে সঙ্গে কবি রাজী হলেন সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাবে । এর
পর নির্দিষ্ট তারিখে তিনি কলকাতায় এসে উক্ত ভবনের ভিত্তি-প্রস্তর
স্থাপন কবেন। বাড়িটির নামকরণও তিনিই করলেন-_“মহাজাতি
সদন” |
ভারতেব এই ছু'জন মহান জননেতাকে পেয়ে শাস্তিনিকেতনের
ছাত্র-ছাত্রীরা তখন আনন্দে উদ্বেল। কিন্তু এই আনন্দের মধ্যেও
নাটকের মহলা ঠিকই চলেছে । স্থিব হয়েছে যে সামনের মাসে
কলকাতায় “তাসের দেশ”, “শ্যামা” আর “চগ্ডালিকা”"র অভিনয় হবে ।
বিহারের জননেতা বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদও (পরে যিনি ভারতের
রাষ্ট্রপতি হন ) ওই বছরই শান্তিনিকেতনে যান রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে
দেখা করতে ।
জননেতাদের সাহচর্ধে এবং নাট্যাভিনয়ের আনন্দে সেপ্টেম্বর মাস
এসে গেল।
হঠাৎ খবর এলো যে, জার্মানীর ফুয়েরার হের হিটলার পোল্যাণ্ড
আক্রমণ করেছেন। কয়েকদিনেব মধ্যেই পোল্যাণ্ডের পতন হলো ।
এর পর হিটলারের নাৎসী-বাহিনী বিছ্যংগতিতে আক্রমণ চালিয়ে
বেলজিয়াম, হল্যাণ্ড, নরওয়ে এবং সুইডেন দখল করে নিল। শুরু
হয়ে গেল দ্িতীয় বিশ্বযুদ্ধ ।
এদিকে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা তখন রীতিমত ঘোরালো৷।
ভারতের ইংরেজ সরকার তখন ভারতবর্ষকে যুদ্ধের ভেতরে টেনে
এনেছেন। ইয়োরোপের যুদ্ধের সঙ্গে ভারতের কোন সম্পর্ক না
থাকলেও এদেশ হঁংরেজের অধীন বলে ওর! গায়ের জোরেই ভারত-
বাসীকে যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে ফেলেছে।
কবি তখন বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু তবুও তিনি প্রতিবাদে
মুখর হয়ে উঠলেন। সবাইকে শুনিয়ে বললেন--এ অস্তায়, রীতিমত
৪% রবীন্দ্রনাথ
*অন্ঠায়। না, ইংরেজের এ ওদ্ধত্য সহ কর! যাঁয় না। আমি এর
বিরুদ্ধে লিখবো ।
সত্যিই তিনি শুরু করলেন রাজনৈতিক প্রবন্ধ লেখা ।
এই সময়ই কবির কাছে আমন্ত্রণ এলে! মেদিনীপুর থেকে ।
“বিষ্ভাসাগর স্মৃতিমন্বির' উদ্বোধন করতে হবে তাকে । কবি সঙ্গে
সঙ্গে রাজী হয়ে গেলেন ।
তারপর নির্দিষ্ট দিনে মেদিনীপুরে গিয়ে উদ্বোধন করলেন
করুণাসাগর বিগ্ভাসাগর-এর স্মৃতিমন্দির । সেখানে এক সংক্ষিপ্ত
ভাষণে তিনি বললেন £
“বঙ্গসাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোকে যদি স্বীকার করে
থাকেন, তবে আমি যেন স্বীকার করি একদ! তার দ্বারোদঘাটন
করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিষ্ভাসাঁগর 1”
মেদিনীপুর থেকে ফিরে এসে আবার তিনি লেগে গেলেন কাজে ।
কাজ আর কাজ ; লেখ। আর লেখা । এর কোন বিরাম নেই। এমনি
করেই কেটে গেল ১৯৩৯ শ্রীষ্টাবা ।
১৯৪০ খ্রীষ্টাব্ধের গোঁড়ার দিকে গান্ধিজী আর কন্তরবাঈ
'শাস্তিনিকেতনে এসে ছুই দিন থেকে গেলেন। কবির শরীর তখন
ভেঙে পড়েছে। তিনি বুঝতে পারছেন, বিদায়ের দিন এগিয়ে আসছে ।
. কিন্তু বিশ্বভারতীর জন্যে তীর চিস্তার শেষ নেই। তিনি তাই গান্ধিজীর
হাতে বিশ্বভারতীর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন । :
কবির শরীর তখন আরও ভেঙে পড়েছে । এই সময় একদিন খবর
এলো যে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিগ্ভালয় কবিকে “ত্র উপাধি দিয়েছেন ।
তখন ছিল আগস্ট মাস। ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার
মরিস গয়ার 'শাস্তিনিকেতন'-এ এসে অক্সকোর্ড বিশ্ববিভ্ালয়ের তরফ
হতে লাটিন ভাষায় একটি মানপত্র পাঠ করে শুনালেন। কবি ভার
গ্রতিভাষণ দিলেন সংস্কতে ।
রবীন্দ্রনাথ ৪১
এর কয়েকদিন পরে কবির শরীর খুবই খারাপ হয়ে পড়লো ।
ডাক্তাররা বললেন_ আপনার এখন কিছুদিন পূর্ন বিশ্রাম দরকার ।
কবি তাদের কথা ন৷ শুনে কালিম্পং রওনা হলেন ।
সেখানে গিয়ে দিন সাঁতেক পরেই হঠাৎ তিনি অত্যন্ত অস্থুস্থ হয়ে
পড়লেন। অবশেষে ২৯শে অক্টোবর তারিখে তাকে অনুস্থ অবস্থায়
কলকাতায় আনা হলো ।
কলকাতায় এসে মাঁস দেড়েক শয্যাশায়ী থাকবার পর সে-যাত
তিনি সেরে উঠলেন ।
এই প্রসঙ্গে প্রতিমা দেবী লিখেছেন £ “দ্বিতীয় মাস থেকে তিনি
সম্পূর্ণ চেতনা! ফিরে পান এবং মুখে মুখে ছড়া তৈরি করেন, কবিতা
লিখতে থাকেন; সেই সময় আশে পাশে ধারা থাকেন তীর টুকে
নিতেন সেই সব রচনা
জ্ঞান ফিরবার প কৰি প্রথম যে কবিতাটি মুখে মুখে রচনা করেন
তার শেষ চারটি লাইন হলো! £
“প্রহর পরে প্রহর যে যায়,
বসে বসে কেবল গণি
নীরব জপের মালার ধ্বনি
অন্ধকারেব শিরে শিরে ।”
এই কবিতাটি তিনি রচনা করেন ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দের ৩০শে অক্টোবর ।
নভেম্বর মাসে কবি আবার 'শাস্তিনিকেতন'-এ গেলেন। তখন
লিখতে তার রীতিমত কষ্ট হতো। তিনি তাই মুখে মুখে কবিতা রচনা
করে যেতেন আর তার ভক্তরা সেগুলে। লিখে ফেলতেন। এই অবস্থায়
তিনি যে সব কবিতা রচনা করেছিলেন সেগুলো! হতে তেত্রিশটি কবিত৷
নিয়ে 'আরোগ্য' নামে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
বর রী সর
১৯৪০ শেষ হয়ে ১৯৪১ খ্রীষ্টাক শুর হলো । আবার এসে পড়ল
কবির জন্মদিন । ১৩৪৮ সালের ২৫শে বৈশাখ ( ইংরেজী ৮ই মে,
৪২ রবীন্দ্রনাথ
১৯৪১)। এই দিনটিই কবির জীবনের শেষ ২৫শে বৈশাখ । সেদিন
কবি লিখলেন £
“আমার এ জন্মদিন মাঝে আমি হারা
আমি চাহি বহুজন যাঁরা
তাহাদের হাতের পরশে
মত্যের অস্ভিম প্রীতিরসে
নিয়ে যাব জীবনের চবম প্রসাদ
নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ ৮
সত্যিই তিনি সেদিন মানুষের শেষ আশীর্বাদ নিয়ে গেলেন।
কারণ এর পর আর তাকে আশীর্বাদ জানাবার স্থযোগ আসেনি
কবি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন । শরীর আর চলছে না । এই
সময় ব্রিটিশ পার্নামেন্টের সদস্তা মিস রাথবেন ভারতবর্ষের প্রতি
কটহুক্তি করে একখান ধোল! চিঠি লেখেন।
রবীন্দ্রনাথ রোগশয্য। হতেই তীব্র ভাষায় তার প্রতিবাদ করলেন ।
আধাঢ় মাস এসে পড়লো । কবি তখন বর্ষার রূপ দেখার জন্তে
উতলা হয়ে উঠলেন । ভক্তদের বললেন--“আমাকে তোমর! বর্ধার
রূপ দেখতে দাও।”
ভক্তর! সঙ্গে সঙ্গে কবিকে উত্তরায়ণের দোতলায় এনে বসিয়ে
দিলেন | সেখানে বসে কবি প্রাণভরে দেখতে লাগলেন বর্ধার রূপ।
কবির অন্তুখ বেড়েই চলেছে। ব্যাপার দেখে সবাই চিস্তিত হয়ে
পড়েছেন। কবির ইচ্ছাক্রমে কবিরাজী চিকিৎসা শুরু হলে ৷ কিন্তু
তাতে কোন ফল না হওয়ায় তাকে নিয়ে আসা হলে। জোড়াসাকোর
বাড়িতে । সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখানো হলো । ডাক্তাররা বললেন,
অপারেশন করতে হবে ;ঃ এখন অপারেশন ছাড। আর কোন চিকিংস
নেই।
কবিকে জানানো হলে তিনি সম্মতি দিলেন। স্থির হলো,
৩০শে জুলাই অপারেশন হবে ।
রবীন্ত্রনাথ ৪৩
অপারেশনের দিন কধি তার সর্বশেষ কবিতাটি যুখে মুখে রচনা,
করেন। এটি তিনি রচনা করেন অপারেশনের কিছুক্ষণ আগে?
পাঠকদের অবগতির জন্তে সেই কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করা
হলো €
“তোমার ্থষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনা! জালে হে ছলনাময়ী !
মিথ্যা! বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হান €
সরল জীবনে ।
এই প্রবঞ্চন! দিয়ে মহত্বেরে করেছ চিহ্নিত,
তার তরে রাখনি গোপন, রাস্তি।
তোমারে জ্যোতিষ্ধ - তারে যে পথ দেখায়
সে যেতার তা
সেযে চি
'গ্তবের পথ ।
এর স্বচ্ছ
নহঃএ বিশ্বাসে সে যে করে তারে চির সমুজ্জল।
বাহিরে কুটিল হোক অস্তরে সে খজু,
এই নিয়ে তাদের গৌরব ।
লোকে তারে বলে বিড়ম্থিত
সত্যেবে সে পায় আসল আলোকে ধৌত অন্তরে
অন্তরে ।
কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে আপন ভাণ্ারে ।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে শাস্তির অক্ষয় অধিকার 1”
এই কবিতাটিই রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতা। এর পর আর
কোনদিন কবি-কণ্ঠে বেজে ওঠেনি কোন সুর । স্তব্ধ হয়ে গেছে
কবির লেখনী ।
৪৪ রবীন্ত্রনাথ
, কিছুক্ষণ গরেই কবির দেহে অস্ত্রোপচার করা হলো। 'কিন্তু তাতে
কোন ফল হলে! না। কবি রীতিমত অনুস্থ হয়ে পড়লেন। বুঝতে
গার! গেল যে, তাঁর শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। অবশেষে ২২শে
শ্রাবণ বাংলার বুলবুল, বাংলা মায়ের আদরের নিধি বাাল্লীর
গর্ব কবিকুলচুড়ামণি রবীন্তরমাথ পৃথিবী হতে চিরবিদায় নিলেন।
নতাঞকল
॥ বিদ্রোহী কবি নজরুল ॥
নজরুল ইসলাম ।
“অগ্নিবীণা'র রচয়িতা বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম । কিন্তু কার
বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ, সেই কথাটাই আগে বলা দরকার। কারণ
ভারতবর্ষে অনেকেই বিদ্রোহ করেছেন । হিন্দু আমলে চন্দ্রগুপ্ত বিদ্রোহ
করেছিলেন মগধের রাজশক্তির বিরুদ্ধে; এবং সে বিদ্রোহে জয়যুক্তও
হয়েছিলেন তিনি। মুসলমান আমলে শিবাজী বিদ্রোহ করেছিলেন ;.
এবং সেই বিদ্রোহের ফলেই গঠিত হয়েছিল শক্তিশালী মারাঠি
সাম্রাজ্য । সাশারামের জায়গীরদার ফরিদশাহ মোগল রাজশক্তির
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অধিকার করে নিয়েছিলেন দিল্লীর সিংহাসন ।
তারপর সেই বিদ্রোহী ফরিদশাহ হয়েছিলেন বাদশাহ শেরশাহ।
বাদশাহ ওরংজীবও বিদ্রোহ করেছিলেন। তিনি বিদ্রোহী
হয়েছিলেন তার পিত৷ সম্রাট শাজাহানের বিরুদ্ধে। পিতাকে আগ্রা
হর্গে বন্দী করে রেখে নিজে সমআাট হয়ে বসেছিলেন। সুলতানা
, বাজিয়ার সভাসদরাও বিদ্রোহী হয়েছিলেন । নারীর শাসনকে বরদাস্ত
করতে রাজী ছিলেন না কারা । তাই সুলতানার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে
তাকে সিংহাসনচ্যুত করেছিলেন । সমাট আকবরের অভিভাবকও
বিদ্রোহী হয়েছিলেন।
ইংরেজ আমলেও অনেকবার বিদ্রোহ হয়। নানা ফড়নাবিশ,
ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ, তাতিয়া তোপি, সিপাই মঙ্গল পীড়ে এবং
আরও হাজার হাজার সিপাই বিঞ্জোহ করেছিলেন ইংরেজ সাগ্রাজ্য-
বাদের বিরুদ্ধে। ভারতের স্বাধীনভা-সংগ্রামীদের দেই এঁতিহাসিক
৪৬ নজরুল
মুক্তিযুদ্ধকে ইংরেজ এবং ইংরেজের স্তাবকর৷ আখ্যাত করে গেছেন
“সিপাহী বিদ্রোহ' নামে ।
ইতিহাস রচনা! করে রাজশক্তির স্তাবকর৷। বাজশক্তিকে খুশী
করবার উদ্দেশে তাদের মনের মত করে ঘটনাকে বিকৃত করে। তাই
যুগে যুগে মুক্তি-পাগল মুক্তিযোদ্ধাদের ওরা চিহ্নিত করে বিদ্রোহী
বলে।
“বিদ্রোহী শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে আছে একটি আপত্তিকর অর্থ ।
অর্থাৎ, যে লোক বিদ্রোহ করে সে অন্যায়কারী এবং যার বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ কর! হয় সে যদি শক্তিমান ও বিজয়ী হয়, অমনি সে হয়ে যায়
হ্যায়বান। আবার কোন বিদ্রোহী যখন রাজ্য অধিকার করে রাজ
হয়ে বসে, তখনই এঁতিহাসিকদের কলম ঘুরে যাঁয়। তখন সেই
বিদ্রোহী আর বিদ্রোহী থাকে না, সে হয়ে যায় ম্যায়পরায়ণ রাজা ।
নজরুলের বিদ্রোহ কিন্তু উপরোক্ত সংজ্ঞায় পড়ে না। তার
বিদ্রোহ অন্যায়ের এবং অসাম্যের বিরুদ্ধে। যেখানেই তিনি অন্তায়
দেখেছেন, সেখানেই তার লেখনী অগ্রিবর্ষণ করেছে সেই অন্তায়কারীর
বিরুদ্ধে-_সে অন্যায় রাজনৈতিকই হোক অথবা সামাজিকই হোক,
তাতে কিছু আসে যায় না। অন্ঠায়কারী সব সময়েই হুক্ভৃতকারী ৷
এবং সেই অন্ঠায়কারীর বিরুছেই ছিল নজরুলের বিভ্রোহ।
তদানীন্তন ইংরেজ সরকার ছিল পয়ল! নম্বরের ছুক্কৃতকারী।
তাই নজরুলের লেখনী বিদ্রোহের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছে ইংরেজের
বিরুদ্ধে। ধর্মের ধবজাধারী মোল্লা-মৌলবী-মোহাস্ত ইত্যাদি তথাকঘিত
ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও নজরুলের জেখনী ছিল ভীমরুলের ছলের
মত। সমাজপতি সেজে যারা অন্যায় কাজ করে চল্তো। তাদের
বিরুদ্ধেও ছিল নজরুলের বিদ্রোহ ।
ইংরেজ তাদের কারাগারে দেশপ্রেমিক যুবকদের বন্দী করে রেখ্ধ-
ছিল। ইংরেজের চোখে তার! রা.জদ্রোহী। কিন্ত সত্যিই কি "গাই?
কেরাজা? কে তাদের রাজ। করেছে? জাল-জোচ্ছুরি, তন্ষরবৃদতি
নজরুল ৪৭
আর হীন বড়যন্ত্র করে যারা দেশের রাজসিংহাসন দখল করেছে,
নজরুলের চোখে তারাই ছুক্কৃতকারী। তাই নজরুল অগ্রিধ্ষী
ভাষায় লিখেছেন ঃ
“কারার এ লৌহ-কপাট
ভেঙে ফ্যাল কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট শিকল-পুজার পাষাণ বেদী-_
ওরে ও তরুণ ঈশান
বাজ! তোর প্রলয় বিষাণ
ধ্বংস নিশান,
উড্ভুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদী।”
কিন্ত কারাগারের লৌহ-কপাট ভাঙতে বললেই তো ভাঙা যায় না ।
ভাঙার জন্তে মানুষ চাই। কোথায় সে রকম মানুষ? বুড়ো-হাবড়া
রোগা-পটক। মানুষদের দিয়ে ও-কাজ হবে না। ওর জন্তে চাই শক্তি-
মান তরুণদল । কিন্তু দেশে যে তরুণরা মেয়েদের পেছনে ঘোরাঘুরি
করে, রাস্তায়-ঘাটে ইয়াঞ্কি মেরে আর সিগারেট ফুঁকে দিন কাটায়,
তাদের দিয়ে ওকাজ হবে না। কিন্তু হবে না বললে চলবে কেন?
ওরাই তো দেশের শক্তি! অতএব ওদেরকে জাগিয়ে তুলতেই হবে ।
তাই নজরুলের লেখনী হতে বের হলো! ঘুম ভাঙানোর কবিতা ঃ
“ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর 1-_ প্রলয় নৃতন ্যজন-বেদন ।
আসছে নবীন--জীবন-হার! অ-সুন্দরে করতে ছেদন ।
তাই সে এমন দেশে দেশে
প্রলয় বয়েও আসছে হেসে-_
মধুর হেসে!
ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-নুন্দর |
তোর! সব জয়ধ্বনি কর 1”
কিন্তু শুধু জয়ধ্বনি করলেই চবে না। নবীনদের এগুতে হবে ;
৪৮ নজরুল
সৈনিকের মত মার্চ করে এগুতে হবে। তাই নজরুল রচনা করলেন
বাংলায় মার্সঙ্গীত £
“চল্ চল্ চল্
উধ্ব গগনে বাজে মাদল,
নিয়ে উতলা ধরণী তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল,
চল্ রে চল্ রে চল্।”
আবার মার্চ করলেই চলবে না । কুচকাওয়াজও শিখতে হবে
তরুণদের । কবি তাই লিখলেন “কুচকাওয়াজ'-এর কবিতা ঃ
“কোথায় মানিক ভাইর! আমার সাজরে সাজ!
আর বিলম্ব সাজে না চালাও কুচকাওয়াজ !
আমরা নবীন তেজ-প্রদীপ্ত বীর তরুণ !-__
বিপদ বাধার ক ছিড়িয়৷ শুষিব খুন !
আমরা ফলাব ফুল কসল।
অগ্রপথিক রে যুবাদল।
জোর কদমে চল রে চল্।
ধর্মের ধ্বজ। ধরে যারা অধর্মাচরণ করে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
ঘোষণা করেছিলেন নজরুল । তিনি লিখেছিলেন £
তব মসজিদে মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাঁবি।
মোল্ল! পুরুত লাগায়েছে তার সকল ছয়ারে চাবি ।
নজরুল চান, এ চাবি ভেঙে ফেলতে । তিনি তাই রুত্রকণ্ঠে
ঘোষণ। করেন £
“খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তাল। ?
সব দ্বার এর খোল! রবে, চালা, হাতুড়ি শাবল চালা 1”
আর একটি কবিতায় নজরুল লিখেছেন £
“মানুষেরে ঘৃণা করি
ও কারা কোরাণ, বেদ, বাইবেল চুদ্বিছে মরি মরি !%*
নজরুল ৪৪
আচারসর্বস্ব সমাজপতিদের কষাঘাত করে কবি লিখেছেন ঃ
“জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াৎ খেলছ জুয়া !
চুঁলেই তাঁর জাত যাবে, জাত ছেলের হাতের নয়ত মোয়া !
ৰলতে পারিস বিশ্বধাত। ভগবানের কোন্ সে জাত!
কোন্ ছেলের তার লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ ?
নারায়ণের জাত যদি নাই,
তোদের কেন জাতের বালাই ?
(তোরা) ছেলের হাতে থুথু দিয়ে মার মুখে দিসধূপের ধোয়া 1”
বিদ্রোহী কবির বিদ্রোহের এখানেই শেষ নয়। আজ যেমন
দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার দেখা যাঁয়, “যেখানে অত্যাচার সেখানেই
প্রতিরোধ”*_কবির লেখনীতেও সেই কথা সে' আমলে লিখিত
হয়েছিল নতুন ছন্দে, জোরালো! ভাষায়। কবি লিখেছিলেন
“আমি সেই দিন হব শাস্ত
যবে উৎগীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না|
বিদ্রোহী রণক্রাস্ত
আমি সেই দিন হব শাস্ত 1”
অত্যাচারিত দেশবাসীকে জাগিয়ে তুলতে, তাদের উদ্ধ হ্ধ করতেও
কবির লেখনী ছিল সোচ্চার । তাই তিনি লেখেন ঃ
“ওরে ক্রন্দন নয় বন্ধন এই শিকল ঝন্বানা,
ও যে মুক্তিপথের অগ্রদূতের চরণ ৰন্দন। !
এই লাঞ্চিতেরাই অত্যাচারকে হানছে লাঞ্থনা,
মোদের"অস্থি দিয়েই আবার জ্বলবে দেশে বজ্জানল 1
জাতিসজ্বের (15886 ০৫ 2৪001) ) বিরুদ্ধেও কবি ছিলেন
বিজ্রোহী। ভার মতে ওটা ছিল চোর জোচ্চোর আর ডাকাতের
আড্ডাখানা। সাধারণ অর্থে যাদের চোর-ডাকাত বল হয়, তাদের
মধ্যে অনেকেই চুরি-ডাকাতি করে পেটের দায়ে, কিন্তু জাতিসজ্ে
৫০ নজরুল
বসে অথবা শীসকের গদীতে বসে যার! চুরি-ডাকাতি করে লোকে
তাদের সমীহ করে। এই শেষোক্ত শ্রেণীর আসল চেহারা নজরুল
তুলে ধরেছিলেন তার স্বভাবসিদ্ধ জোরালে৷ ভাষায়। পেটের
দায়ে যারা চুরি-ডাকাতি করে তাদের প্রতি ছিল নজরুলের
সহানুততি; কিন্তু তাবড় তাবড় চোর-ডাকাতদের তিনি ক্ষমার
চোখে দেখেননি । তিনি তাই লিখে গেছেন £
“কে তোমায় বলে ডাকাত, বন্ধু; কে তোমায় চোর বলে?
চারিদিকে বাজে ডাকাতি-ডঙ্কা, চোরেরি রাজ্য চলে ।
ছোটদের সব চুরি করে আজ বড়রা হয়েছে বড়।
যারা যত বড় ডাকাত, দস্থা, দাগাবাজ,
তার! তত বড় সন্ন্যাসী গুণী জাতিসজ্ঘেতে আজ ৮
অত্যাচারী ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধেই কবির লেখনী সবচেয়ে
বেশী সোচ্চার ও বেশী তীব্র ছিল। তিনি তাই ইংরেজ শাসকদের
উদ্দেশ্তে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন £
“( তোমর! ) ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়,
( সেই ) ভয়ের টু"টিই ধরব টিপে, করব তারে লয়।
( মোরা ) আপনি ম'রে মরার দেশে আনব বরাভয়,
(মোরা ) ফাঁসি পরে আনব হাসি মৃত্যুজয়ের ফল ।”
কিন্তু ইতস্ততঃ কবিতা লিখেই বিদ্রোহী কবি ক্ষান্ত হলেন না।
তিনি তার নিজের সম্পাদনায় বের করলেন '“ধুমকেতু* নামক সাময়িক
পত্রিকা । ধূমকেতুর জন্মলগ্নে কবিগুরু আশীর্বাদ জানালেন £
“আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু !
আধারে বাধ অগ্রিসেতু,
হুর্দিনের ওই হর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় চেতন /
অলক্ষণের তিলক রেখ
রাতের ভাসে হোল না লেখ
নজরুল ৫১
জাগিয়ে দে রে ধমক মেরে
আছে যারা অর্ধ--চেতন।”
বিশ্বকবির এ নির্দেশ অক্ষ্যর অক্ষরে পালন করেছেন নজরুল ।
'ধূমকেতু'নর প্রথম শারদীয় সংখ্যায় দশভুজ। ছুর্গাদেবীকে বন্দনার ছলে
নজরুল লিখলেন £
“আর কতকাল রইবি বেটি
মাটির ঢেলার মতি আড়াল 1?
স্বর্গকে আজ জয় করেছে
অত্যাচারীর শক্তি-টাড়াল'
দেব-শিশুদের মারছে চাবুক,
বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি
ভূ-ভারত আজ কসাইখান!
আসবি কখন সর্বনাশী ?”
এই কবিত৷ পড়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে ইংরেজ সরকার । “ধূমকেতুর
শারদীয় সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করলো৷ তারা । কবি নজরুলকেও তারা
গ্রেপ্তার করে বিচারালয়ে হাজির করলো রাজদ্রোহমূলক কবিতা
রচনার অভিযোগে ।
কলিকাতার চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনা হলো
কবিকে । দাড় করিয়ে দেওয়া হলো৷ আসামীর কাঠগোড়ায়। সরকারী
উকিল জোরালো বক্তৃতা দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করলে! যে, নজরুল
ইসলাম রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। '
এর উত্তরে কৰি তার এঁতিহাসিক জবানবন্দীতে বলেন £
“আমি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে,
বিদ্রোহ করেছি। আমি জানি এবং দেখেছি, আজ এই আসামীর
পিছনে স্বয়ং সত্য সুন্দর ভগরান দাড়িয়ে। যুগে যুগে তিনি এমনি
নীরবে তার রাজবন্দী সত্য সৈনিকের পশ্চাতে এসে দণ্ডায়মান হন।
রাজা-নিষুক্ত বিচারক সত্য বিচারক হতে পারেন না। এমনি বিচায়
৫২ নজরুল
প্রহসন করেই সেদিন শ্রীষ্টকে ক্রসবিদ্ধ করা হলে৷। গান্ধীকে
কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো, সেদিনও ভগবান এমনি নীরবে
দাড়িয়েছিলেন তাদের পিছনে এসে । বিচারক কিন্ত তাকে দেখতে
পাননি। তার আর ভগবানের মধ্যে সম্রাট দাড়িয়ে ছিলেন ।
সম্রাটের ভয়ে বিচারকের বিবেক দৃষ্টি অবাক হয়ে গেছলো ।.""
আমার বাঁশি কেড়ে নিলেই বাঁশির সুরের মৃত্যু হয় না। কেন
না, আমি আর এক বাঁশি নিয়ে বা তৈরি করে তাতে সেই স্থুরে
ফুঁ দিতে পারি। সুর আমার বাঁশিতে নয়, সুর আমার মনে এবং
আমার বাঁশির হ্থষ্টির কৌশলে ।*'.দোষ আমারও নয়--দোষ তার,
যিনি আমার কর্ণে বীণা বাজান। প্রধান রাজদ্রোহী সেই বীণাবাদক
ভগবান। তাকে শাস্তি দেবার মতো রাজশক্তি ব৷ দ্বিতীয়
ভগবান নাই ।”
কবি ঠিকই বলেছিলেন যে, সম্রাটের ভয়ে বিচারকের বিবেক
ঝাপসা হয়ে যায়। এ মামলাতেও তাই হলো। কবি নজরুল
ইসলামাক এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলেন ইংরেজ
ম্যাজিস্ট্রেট ।
এর পরেই শুরু হলে! নজরুলের কারা-জীবন ৷ কিন্তু তার সেই
কারাজীবনের কথা, অথবা! তার বন্ুমুখী প্রতিভার কথা বলবার আগে
তার ব্যক্তিগত পরিচয় অর্থাৎ বংশ-পরিচয়, পিতৃমাতৃ-পরিচয়, জন্ম,
বাল্যকাল এবং শিক্ষাকাল সম্বন্ধে কিছু বল! দরকার বোধ করছি।
নজরুলের বংশ-পরিচয় ও বাল্যজীবন আমি নিজের কথায় ন৷ লিখে
সাহিত্যিক মইনুদ্দিন এবং ইন্দ্রজিং রায়ের রচন্বা থেকে প্রয়োজনীয়
অংশ উদ্ধত করে দিলাম £
॥ জন্ম ও বাল্যজীবন ॥
তেরশ ছয় সালের এগারই জ্যৈষ্ঠ নজরুল ইসলাম পৃথিবীর মাটি
প্রথম স্পর্শ করেন। তার বাবার নাম কাজী ফকির আহম্মদ এবং
মায়ের নাম জাহেদ! খাতুন। বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে বাস
করতেন তারা ।
ফকির আহম্মদ সাহেব ছিলেন ধর্মীরু মানুষ । নমাজ, রোজা
আর তসবীহ-তেলাওয়াৎ নিয়েই মসগুল থাকতেন তিনি । তাদের
বাড়ির কাছেই ছিপ 'পীর-পুকুর নামে একটা দীঘি। সেই
দীঘির পাড়ে হাজী পাহলোয়ান নামে এক গীর সাহেবের মাজার
শরীফ আর একটি মসজিদ ছিল ' এই মাজার আর মসজিদের
খেদমত করেই ফকির আহম্মদ সাহেব দিন কাটাতেন।
ছেলেবেলায় নজরুল ইসলাম ছিলেন খুবই হষ্ট। তার ছুট্মির
জ্বালায় সবাই যেন ভয়ে কীপতো। কত রকমের হ্রমিই ষে
তার মাথায় খেলতো, তার ইয়ত্তা নেই। পাখির ছান! পাড় থেকে
আরম্ভ করে মানুষের “পাকা ধানে মই” দেওয়া পর্যস্ত কোন ছুষ্টমিতেই
তিনি পিছপা ছিলেন না। মাঝে মাঝে তার ছষ্্মি একেবারে মাত্রা
ছাড়িয়ে যেতো । গ্রামের হট ছেলেদের তিনি ছিলেন সর্দার ।
' তার বাবা তাঁকে গ্রামের মক্তবে ভি করে দিয়েছিলেন ।
সেখানে তিনি কিছু কিছু ফার্সী আর কেরান শরীফ পড়েছিলেন । হট
ছেলেদের একটা মজা এই যে, হু্টরমিতেও তারা! যেমন ওস্তাদ হয়
আবার পড়াশুনাতেও তারা হয় সবচাইতে ভাল । নজরুল ইসলামের
বেলায়ও এই কথা ট খাটে। দশ বছর বয়সে তিনি যখন মক্তবের পড়
শেষ করলেন, তখন দেখা গেল, তিনি যেটুকু শিখেছিলেন তার মধ্যে
কোন গলদ নেই। কোন ফ্কাকি নেই। এই বয়সেই তিনি উর্্ঠআর
ক্ষার্সী এমন বুজ্দরভাবে উচ্চারণ করতেন যে, ঘা শুনে সবারই তাক
_. ম্ববীজেনাথ--৪
৫৪ নজরুল
/
'লেগে যেতো । তার খোশ, এলহানে কুরআন শরঁফি তেলাওয়াত
শুনে বড়ো বড়ো মৌলভী মওলানা সাহেবরাও খুশিতে তার পিঠ
চাপড়াতেন। মক্তবের পড়া শেষ করলেন তিনি দশ বৎসর বয়সে ।
এর পরেই তার পড়াও গেল বন্ধ হয়ে; কারণ, তার বাবা তখন মারা
গেছেন। তার ছুঃখিনী মা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে অকুল
সাগরে ভাসলেন ।
গরীবের সংসার । খেতেই কুলোয় না, তাকে পড়াবে কে?
এক বছর পর্যন্ত নজরুল ইসলাম এ মক্তবেই শিক্ষকতা করলেন।
এই সময় তিনি গ্রামে মোল্লাকী করতেন আর মসজিদে ইমামতী
করতেন। কিন্তু এই ব্যবস্থা তার অশান্ত মন কিছুতেই মেনে নিতে
পারলো না। অভিভাবকহীন নজরুলের মনট! লাগাম-ছেঁড়া ঘোড়ার
মতো! যেদিকে ইচ্ছা ছুটে যেতে লাগলো ।
তাঁর এক চাচার নাম ছিল কাজী ফজলে করীম। তিনি ফাসীতে
ভাল কবিতা লিখতে পারতেন। তার সেই কবি-প্রতিভার ছায়া
নজরুলের জীবনেও পড়েছিল। কবি তাই অল্প বয়সেই নানা রকমের
ফা্্ণ বাংল! মেশানো কবিতা লিখতে চেষ্টা করতেন । মাঝে মাঝে
ছ'একটা কবিতা বেশ ভালো হয়েও যেতো ।
পাশের গ্রামে 'লেটো; গানের একটা দল ছিল। তার! যাত্র!
গানের মতে! এক রকম পালা গান করতো । নজরুল মাঝে মাকে
তাদের জন্তে পাল! গান লিখে দ্িতেন। এতে তার ছ'পয়সা
রোজগারও হতো। এই অল্প বয়সেই তিনি পাল! গান লিখে বেশ
শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন । তার গানের আদরও খুব বেড়ে গিয়ে-
ছিল। কিন্তু গ্রামের এ ছোট্ট জায়গায় তিনি নিজেকে ধরে রাখতে
চাইলেন না; একদিন গ্রাম থেকে পালিয়ে চলে গেলেন
আসানসোলে।
পালিয়ে তো গেলেন, কিন্তু খাবেন কি? * পেট বড়ো দারুণ।
জিনিস। একদিন আহার না জুটলেই চোখে আধার দেখতে হয়,
নজরুল ৫
তিনি তাই পাঁচ টাকা মাইনেয় ময়দা মাখার কাজ নিলেন একটি'
রুটির দোকানে । ্
তিনি দিনের বেলা ময়দা মাখেন আর রাত্রে অবসর সময়
স্বর করে পুঁথি পড়েন ও গান গেয়ে সকলকে মাতিয়ে তোলেন
এবং বাজন! বাজিয়ে পাড়া তোলপাড় করেন। এই সব কারণে
অনেকেরই নজর পড়লো! তার উপর ।
আসানসোলে কাজী রফিউদ্দিন নামে একজন দারোগ! ছিলেন।
নজরুলের গুণের পরিচয় পেয়ে তিনি মুগ্ধ হলেন। ভাবলেন, একে
লেখাপড়।৷ শেখাতে পারলে কালে হয়তো খুব বড় কাজ করতে
পারবে । তিনি নজরুলকে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এলেন।
তার বাড়ি ছিল ময়মনসিং জেলার কাজীর-শিমলা গ্রামে । এর
কাছেই দারিরামপুর হাইস্কুল। সেখানে তিনি নজরুলকে ভর্তি করে
বিলেন। এই স্কুলে নজরুল মাত্র এক বৎসর পড়েন। এই সময়
স্কুলের হেডমাস্টার বদলি হয়ে যাওয়ায় নজরুলের মন ওখানে টিকলো।
না। ঠিনি রাণীগঞ্জে গিয়ে সিয়ারসোল হাইস্কুলে ভি হলেন।
হাইস্কুলে ভি তো হলেন; কিন্তু তার অশাস্ত মন স্কুলের
বাঁধাধরা নিয়মের সঙ্গে কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারলো না। তিনি
স্কুলের বই ছেড়ে বাইরের বই পড়েন, পরীক্ষার খাতায় কবিতা
লিখে নিজের শক্তির পরিচয় দেন; এমনিভাবে হ-্য-ব-র-ল আর
গোঁলমালের মধ্যে তিনি ক্লাশ টেন পর্যস্ত উঠলেন।
তখন পৃথিবীতে যুদ্ধের দামাম! বেজে উঠেছে। দলে দলে লোৌক
পল্টনে ভঠি হয়ে লড়াইয়ে যাচ্ছে । নজরুলও “বাঙালী পল্টন'এ
নাম লিখিয়ে একদিন করাচী চলে গেলেন।
করাচীতে যে পল্টনের দলে নজরুল স্থান পেলেন সেই দলে
একজন ফার্সী জান! মৌলভী ছিলেন। তার সাহায্যে নজরুল ভাল
ভাল ফার্সী কবিতার বই, বিশেষ করে হাজেজের বইগুলি গড়ে
নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাংল। ভীষায় দিতে লাগগেন তার প্রতিরপ --*
্উ নজরুল
আগেই বল! হয়েছে যে, নজরুল ইসলামের পিতা ফকির আহমদ
সাহেব ছিলেন ধর্মভীরু মানুষ |
দরগাহে থাদেমগিরি করে মমজিদে ইমামতী করে আর ভক্ত-
'জনদের বাড়িতে মিলাদ শরীফ পাঠ করে সামান্য যাঁ কিছু পেতেন,
তাই দিয়ে স্ত্রী, তিন পুত্র ও এক কন্ঠার ভরণপোষণ করতেন তিনি ।
এ ছাড়া দলিল-দস্তাবেজ লিখেও তিনি কিছু রোজগার করতেন। '
পিতার দরিপ্রতার জন্যে নজরুল উচ্চ শিক্ষা লাভের স্থযোগ
পাননি । ফকির আহমদ সাহেব যখন লোকাস্তরিত হন, নজরুল
তখন আট বছরের বালক। তবু সেই বয়সেই মা-ভাইবোনদের
বাঁচিয়ে রাখার স্বাভাবিক প্রেরণায় আসানসোলে একটা চাকরি
যোগাড় করে নিয়েছিলেন।
ঠার মতো অল্পশিক্ষিত, অন'ভজ্ঞ আর অপরিণত বয়স্ক কিশোরের
কাজই ব। কি আর মাইনেই বা কত! তবু অনটনের সংসারে
একেবারে অনাহারে দিন না কাটিয়ে অর্ধাশন তে! জুটবে! এই
আশাতেই কাজটা যোগাড় করেছিলেন নজরুল ৷ কিন্তু তার ম৷ তাকে
ও চাকরি করতে দিলেন না ।
এত অভাব, এত কষ্ট--তবু নজরুলের পড়াশোন! বন্ধ হতে
দেন নি জাহিদা বিবি। তিনি যে কি অভাবে ছেলেকে তখনও
গ্রামের মক্তবে পড়িয়ে চলেছিলেন তা ভাবলে রীতিমত আশ্চর্য
হতে হয়।
নজরুলের লেখাপড়ার প্রথম ধাপ শুরু হয় তার বাবার কাছে।
বাবাই ছিলেন তীর সর্বপ্রথম শিক্ষাগ্তরু। তারপর অক্ষর পরিচয়
শেষ হলে তাকে ভি করে দেওয়া হয় গ্রামের মক্তবে।
মক্তবের শিক্ষক ছিলেন মৌলভী কাজী বজলে আহমর্দ সাহেব ।
উর্তঘ আর বাংল! ভাষার তার চমংকার বুৎপত্তি ছিল। বাংলা
বানান শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে নজরুলকে তিনি আরবীও শেখাতে
থাকেন।
নজরুল গণ
খুৰ মেধাবী ছাত্র ছিলেন নজরুল ইসলাম। মক্তবের শেষ
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার আগেই তিনি বেশ সাবলীলভাবে আর
নিভূ্লি উচ্চারণে “কোরাণ শরীক' পাঠ করতে পারতেন। বছর ছুই
পরে নজরুল ইসলাম মক্তব থেকে প্রাথমিক শেষ পরীক্ষায়
সসম্মানে উত্তীর্ণ হলেন। কিন্তু ছেলেকে হাইস্কুলে পড়াবার ফে
তর্বার বাসনা ছিল জননী জ্াহিদা বিবির অন্তরে, তা ব্যর্থ হয়ে গেল
কঠোর দারিদ্রের জন্যে ।
এদিকে অর্থাভাব তখন চরমে উঠেছে । বাড়িন্ুদ্ধ সবাইকে
প্রায় অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে । এই অবস্থা দেখে কিশোর
নজরুলকে চাকরির সন্ধানে বেরুতে হলো। অবশেষে চাকরিও
একটা জুটে গেল। যে মক্তব হতে নজরুল পাশ করে বেরিয়েছেন
সেই মক্তবেই গুরুগিরির চাকরি জুটলে! তাঁর। নজরুল ইসলাম
হলেন সেই মক্তবের মৌলভী সাহেব ।
মাইনে যেমন উল্লেখযোগ্য নয়, তেমনি নিয়মিতও নয়। তবে
নিয়মিত যা পাওয়া যেতো, তা হলো! ছাত্রদের বাড়ি থেকে পাঠিয়ে
দেওয়া! সিদে -_অর্থাৎ কিছু চাল-ডাল-কলা-মূলো-বেগুন-কাচকলার
ভালি। সিদের পরিমাণ অবশ্য বেশী হবার কথা নয়--কারণ
ছাত্রসংখ্যা ছিল নগণ্য, তার ওপর সকলের বাড়ির অবস্থাও সমান
নয়। তবু মন্দের ভাল হিসাবেই জাহিদা বিবি এটাকে মেনে
নিলেন। আর না মেনে উপায়ই বা কি!
শুধু পাঠশালার গুরুগিরিই নয়, সেই সঙ্গে আরও একটি সম্মানের
কাজ জুটে গেল নজরুলের। কাজটি হলে স্থানীয় মসজিদের
ইমাম আর মোয়াজ্দীনের পদ। কিন্তু পদটি যত গুরুতর, পদাধিকারী
লোকটি কিন্তু তত.হালক! ; কারণ নৰীন ইমাম আর মোয়াজ্জীনের বয়স
তখন সবেমাত্র এগারো বছর। চুরুলিয়া গ্রামের ইতিহাসে-_
সম্ভবত সার! মুসলীম জাহানের ইতিহাসে কোন মসজিদে এত অল্ল-
বয়স্ক ইমাম এই প্রথম।
৮ নজরুল
নজরুলের এক দূর-সম্পর্কের চাঁচা ছিলেন। তাঁর নাম মুন্সী
বজলে করিম। এই চাচার কাছে ইসলামের সবক নিতে গিয়ে
নজরুল সবিশ্ময়ে লক্ষ্য করলেন ষে, চাঁচা সাহেব বাংলা গান ও উর
গজল লেখেন । শুধু লেখেনই না, তাতে সুর দিয়ে গুনগুন করে
গেয়েও থাকেন ।
তার সেই কবিতা আর স্তরের বঙ্করর নজরুলের হৃদয়কে নাড়া
দিল। তার মনের পাপিয়া, বুলবুল আর দোয়েল শ্যামারা চঞ্চল হয়ে
উঠলে! সেই ছন্দের আঘাতে ! চাচার দেখাদেখি তিনিও তখন
লিখতে শুক করলেন গজল । ৃ
নজরুলের সে সময়কার লেখা একটি গজলের নমুনা নিচে দেওয়।
হলে £
“নমাজ পড়ো মিঞা ওগো নমাজ পড়ো মিঞা,
সবার সাথে জমায়েতে মসজিদেতে গিয়া
তাতে যে নেকী পাবে বেশী
পর সে হবে খেশী
থাকবে নাকো কীনা, প্রেমে পূর্ণ হিয়া ॥”
এদ্রিকে সংসারের অভাব গুখন সমানেই চলছে। নজরুল
যে সামান্য আয় করেন তাতে সকলের খাওয়া-পরা৷ চলে না।
খিদের জ্বালায় ছোট ভাই আলি হোসেন আর কচি বোন
কুলসম যখন অবুঝের মতো! কাদতো! তখন মায়ের কাতর ও অসহায়
মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইতে
নজরুলের ।
ক্ষুধার্ত ভাই-বোনের কাতরানি, অসহায় মায়ের চোখের জল
এবং নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে নজরুলের মন চঞ্চল হয়ে উঠলো ।
তিনি তাই রুজিরোজগারের জন্যে অন্য কোন পথের সন্ধান
করতে লাগলেন। ৃ
যে সময়ে চুরুলিয়া এবং আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে “লেটো' গান
শজকুল চা
খুব জনপ্রিয় ছিল। অনেকটা! যাত্রার দলের পাল! গানের মতই ছিল
লেটেো গান। নজরুল একট। গান লিখে লেটোর দলের প্রধানকে
পড়তে দিলেন। গানটি পড়ে তার খুবই পছন্দ হলো। তিনি বললেন-_
এ গান চলবে। তুমি আরও লেখো । আমি পয়স! দিয়ে তোমার
লেখা গানগুলো কিনে নেব ।
নজরুল তখন শুর করলেন গান শ্লেখা। এবং কয়েক দিনের
মধ্যেই অনেকগুলো গান লিখে দিলেন “লেটো” পালার জন্তে।
দলের কর্তা গানগুলে। নিয়ে কয়েকটা টাকা দিলেন নজরুলকে ।
গান লিখে টাকা রোজগার করা যায় দেখে নজকল ইমামততী
ছেড়ে দিয়ে লেটোর দলে যোগ দিলেন । এতে তার পেটের ক্ষুধা
আকাক্ষিতভাবে মিটলো! না সত্য, তবে মনের ক্ষুধা পরিপূর্ণভাবেই
মিটলো । তার শুকিয়ে আস! প্রাণতরু আবার রঙে রসে আর রূপে
সজীব হয়ে উঠলো । কিছুদিনের মধ্যেই নজরুল ইসলাম আবার
প্রাণবস্ত কিশোর হয়ে উঠলেন । তার মুখে দেখা দিল হাসি, প্রাণে
জেগে উঠলো কবিতা--যে কবিতা গান হয়ে বরে ঝরে পড়তে লাগলো!
তার স্থুধাক্ঠ থেকে । বাংলার বুলবুল মাতিয়ে তুললেন কবিতা
আর গানের গুল-বাগিচা ।
এর পর কিভাবে তিনি ময়মনসিং জেলায় গিয়ে পড়াশুনা! করেন
এবং সেখান থেকে ফিরে এসে সিয়ারসোল স্কুলে দশম শ্রেণী
পর্যস্ত পড়ে “বাঙালী পল্টন-এ যোগ দেন সেকথা আগেই বলা
হয়েছে । বাঙালী পণ্টনে নজরুল প্রথমে ঢোকেন সিপাই হয়ে।
পরে তার পদোক্পতি হয়ে তিনি হন হাবিলদার ।
॥ সৈনিক হুলেন কবি ॥
বাঙালী পণ্টন ভেঙে যাবার পরে ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে নজরুল যখন
কলকাতায় এলেন তার কিছুদিন আগে থাকতেই “সওগাত, ও বঙীয়
মুসলমান সাহিত্যে সমিতির পত্রিকায় ছোট গল্পের ধরনে তার কয়েকটি
লেখা বেরিয়েছিল । সেই লেখাগুলো! তখন বেশী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ
করেনি ; কারণ এ সব পত্রিকার গ্রাহকসংখ্যা খুব বেশী ছিল না।
কিন্তু যাদের চোখে পড়েছিল তাঁদের বেশ একটু চমক লেগেছিল।
লেখাগুলো যে খুব পাকা ছিল না সে সম্বন্ধে তাদের বুঝিয়ে বলার
বিন্দুমাত্র প্রয়োজন ছিল না। তাদের চমক লেগেছিল এই জন্যে যে,
লেখাগুলোয় বিজ্ঞতার অভাব থাকলেও সেলে প্রাণ-সম্পদে ভরপুর
ছিল।
নজরুল যখন কলকাতায় এলেন তখন তার বয়স মাত্র বিশ বছর ।
গড়ন নাতিদীর্ঘ কিন্তু সুঠাম। তাছাড়া চোখ ছটি কিছু বেশী চঞ্চল
ও উজ্জল-_ন্সেহ মমত| কাড়বার অপূর্ব যাহ ছিল সে চোখ ছুটিতে ।
কণ্ঠে তার অজত্র গান, বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথের গান, আর কারণে-
আকরণে প্রাণধোল। উচ্চ হাসি। এই প্রাণ-চাঞ্চল্যের জন্তেই নজরুল
জনপ্রিয় হয়েছিলেন অতি অল্প দিনে ।
চিরে কবিত৷ রচনায় মন দিলেন তিনি । তখন কারোরই জানা
ছিল না, উর্ঘ ও বাংল] পদ মিশানো কবিত রচনায় অল্প বয়সেই
তিনি অভ্যস্ত হয়েছিলেন । করাচী সেনানীবাসেই এ ব্যাপারে তার
হাতে-খড়ি হয়েছিল । এবং সেখানে থাকতেই তিনি উর্ঘ আর বাংলা
শব্দ মিশিয়ে কৰিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। হাফিজের কবিতার
কিছু কিছু অন্থবাদও তিনি এ-সময়ে করেন। দেশে এই সময়ে শুরু
হয় অসহযোগ আন্দোলন। সে আন্দোলনের তীব্রতা হতই বেড়ে
নজরুল ৬১
চললো, নজরুলের রচনা-শক্তিও ততই উৎকর্ষ লাভ হতে লাগলো ।
তার যে কবিতাটি সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে খ্যাতি লাভ করলো, সেটির
নাম “সাত-ইল্-আরব”। ১৩২৭ সালে জ্যৈষ্ঠের মোসলেম ভারত*-
পত্রিকায় এটি প্রকাশিত হয়। ব্বর্গত বিনয় সরকার মহাশয় (তিনি বোধ
হয় তখন ইউরোপে ছিলেন) ওই কবিতাটির উচ্ছৃসিত প্রশংসা করে-
ছিলেন। কবিতাটির একটি স্তবক এই রকম £
“ছুষমন্-লোছ ঈর্ধায় নীল
তব তরঙ্গে করে ঝিলমিল,
বাকে বাকে রোষে মোচড় খেয়েছে পিয়ে নীল খুন পিগারীর !
জিন্দা বীর
'জুলফিকার' আর হায়দারী হাঁক হেথা আজে! হজরত আলীর
সাতিল-আরব ! সাতিল আরব !! জিন্দা রেখেছে তোমায় তীর 1”
কোন কিছুকে প্রবলভাবে ভালবাসার বা ঘৃণা করবার কাল যৌবন।
অত্যাচারীর প্রতি নবীন কবির সেই প্রবল সহজ ম্বণা অদ্ভুত রূপ
পেয়েছে এর ক'টি ছত্রে।
এর পর তার যে কবিতাটি ব্যাপক প্রশংসা লাভ করলো সেটি হলো
“খেয়া পারের তরণী'। এই কবিতাটি শ্রাবণের “মোসলেম ভারত'-এ
প্রকাশিত হয়। উক্ত পত্রেরই ভান সংখ্যায় মোহিতলাল মজুমদার
নজরুলের উচ্চ প্রশংসা করেন। “মোসলেম ভারত'-এর ভান্র সংখ্যায়
প্রকাশিত “কোরবাণী' কবিতাঁটিও জনপ্রিয় হলে ; কিন্তু উক্ত পত্রের
আস্বিনের সখ্যায় প্রকাশিত কবির “মহর্রম' কবিতাটি বেদনায়,
গভীরতায় আর ছন্দ ও মিল-এর অপূর্ব চাতুর্ষে বাংলার রসিক সমাজেয়
চিত্ত একেবারে জয় করে নিল। এর প্রথম ছুটি স্তবক হলো ঃ
“নীল সিয়া আসমান লালে লাল হুনিয়া,__- '
“আন্ম৷ লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া'
৬২ শজরুল
কাদে কোন্ ত্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,,
সে কাদনে আস্থ আনে সীমারেরও ছোরাতে !
রুদ্র মাতন উঠে ছুনিয়া__দামেশকে-_
'জয়নালে পরালে এ খুনিয়ার বেশকে ?
হায় হায় হোসেন” এ রোল ওঠে বঞ্ধায়,
তলওয়ার কেঁপে ওঠে এজিদের পাপ্ায় ?
লক্ষ্য করার আছে খেয়া পরের তরণী'-র ও “মহর্রম'-এর রূপ
কল্পনায় মুসলমান সমাজের প্রচলিতধ্যান-ধারণার রদবদল করতে তিনি
কিছুমাত্র চেষ্টা করেননি। শুধু তাঁর ভাবাবেগের গাঁততা৷ ও অপূর্ব
শব্ধ যোজনা-সামর্থ তাকে এমন অভাবনীয় সাফলা দান করেছে।
“মহর্রম" কবিতাটি এক অতিশয় শক্তিশালী মগ্সিয়াগীতি, তার সঙ্গে
তাতে প্রকাশ পেয়েছ সেই সময়কার খেলাফত্ আন্দোলনের যুগের
মুসমমানের দিগত্রাস্ত মানসিকতা । এই অধুনা-পরিত্যন্ত শেষ ছুটি চরণ
লক্ষ্যণীয় ঃ
“দুনিয়াতে ছূর্মদ খুনিয়ারা ইসলাম ।
লোহু লাও নাহি চাই নিষ্কাম বিশ্রাম ॥”
এই তিনটি কবিতা পড়ে বাংলার রমিক সমাজ সেদিন যেরূপ
অকৃত্রিম অনুরাগে নজরুলের শিরে কবি-যশের মুকুট পরিয়ে
দিয়েছিলেন তার দৃষ্টাস্ত ইতিহাসে খুব বেশী নেই। এই সমঝদারির
পরিচয় দিয়ে বাংলার রসিক সমাজ সেদিন অবিবেচনার পরিচয়
দেননি । এই তিনটি কবিতায় বাস্তবিকই রয়েছে নজরুল-প্রতিভার
এক বিশিষ্ট পরিচয়-_ অপূর্ব বীর্ধবস্ত তরুণ কবির শিল্প-প্রতিভার প্রথম
পরিচয় যা পরবততীকালে কোন কোন ক্ষেত্রে তার গ্রতিভার মহত্তর
পরিচয়ের মধোও আত্মপ্রকাশ করেছে।
॥ কবি কেন বিদ্রোহী হলেন ॥
নজরুলের বন্ুমুখী প্রতিভা এবং তাঁর জীবনের বিভিন্নমুখী ঘটনা-
বলীর পরিচয় দিতে গেলে বিরাট সাইজের বই লিখতে হয়। আমরা
তাই কবির জীবনের কয়েকটি মাত্র মোড় সম্বন্ধে আমাদের আলোচনা
সীমাবদ্ধ রাখবো ।
নজরুল অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন।
শিশুদের জন্যে তিনি লিখেছেন £
“ভোর হলো দোর খোলো, খুকুমণি ওঠরে”
এঁ ডাকে জুঁই শাখে ফুল খুকি ছোটে রে,
খুকুমণি ওঠো রে!
রবিমাম! দেয় হাম! গায়ে রাঙা জামা এ,
দারোয়ান গায় গান শোনো! এ 'রামা হৈ? 1”
আবাঁর---
“কাঠবিড়ালী? কাঠবিড়ালী, পেয়ারা তুমি খাও?
গুড় মুড়ি খাও? ছুধ ভাত খাও? বাতাপি নেবু ? লাউ?
বিড়াল বাচ্চা? কুকুরছানা? তাও?”
আরও আছে-_ |
“বাবুদের তালপুকুরে,
'হাবুদের ভাল কুকুরে,
সে কি ব্যস করল তাড়া,
বলি থাম্ একটু ধাড়া_»
এই বলে, কুকুরের তাড়া খাওয়ার যে কাহিনীটি তিনি বর্ণনা
করেছেন অনবন্থ কবিতার মাধ্যমে তার কোন তুলনা! নেই।
৬৪ নজরুল
আবার একই লেখনীতে রচিত আছে বিচিত্র স্বাদের"গজল গান ।'
“বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল ।৮
এবং-_
“আমারে চোখ ইসারায় ডাক দিলে হায়, কে গে দরদী” |
আবার-_
“ভুলি কেমনে, আজি যে মনে,
বেদনা সনে রয়েছে আকা1।”
এছাড়া আরও যে কত গান তিনি রচনা করেছেন তার কোন
লেখাজোখা নেই। ও
কিন্ত নজরুলকে আমর! শিশুদের কবি বা গীতিকার না বলে
বিদ্রোহী কৰি বলি কেন, সেই কথাটাই এখানে আলোচনা করতে চাই।
আগেই বলেছি যে, সৈনিক-জীবনের পরে নজরুল যখন কবিত৷
লিখতে শুরু করলেন, দেশে তখন “খিলাফৎ আন্দোলন এবং
“অসহযোগ আন্দোলন” চলছে । এই ছুটি আন্দোলনের ঢেউ এসে
কবির মনেও আঘাত করে। ক্রমশঃ ইংরেজ সরকারের অত্যাচার
আর অবিচারের ঘটনাগুলো তার মনকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়।
চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিহ্রেট করুক সুশীল সেনকে বেত্রদণ্ড দান,
ক্ষুদিরামের ফাঁসি, প্রফুল্ল চাকীর আত্মদান, সত্যেন আর কানাইলালের
ফাঁসি প্রভৃতি ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে কবির মন বিষিয়ে ওঠে ইংরেজ
পাজশক্তির বিরুদ্ধে। এছাড়া সমাজপর্তি সেজে যারা অসামাজিক
কাজ করে চর্লিছে এবং ধর্মের ভান করে যারা অধর্ম করে চলেছে,
তাদের বিরুদ্ধেও নজরুলের মনটা বিষিয়ে ওঠে ।
তিনি তাই তার রচনা শক্তিকে নতুন পথে ঘুরিয়ে দেন। এবং সে,
পথ হলো বিদ্রোহের পথ।
এর পর থেকেই আমরা নজরুলকে দেখতে" পাই এক নতুন
রূপে-বিভ্রোহী কবি হিসেবে ।
নজরুল ঙ৫
তাই নজরুলের শিশু-কবিতা, ধর্মের কবিতা, গজল এবং আরও
নানা রকম গানকে ছাড়িয়ে প্রাধান্য পায় তার বিদ্রোহেয় সুরে রচিত
কবিতাগুলি। এবং এই কারণেই কবি নজরুল ইসলাম আখ্যাত হন,
বিদ্রোহী কবিরূপে।
॥ নজরুলের কবিতায় সাম্যবাদ ॥
আগেই বলেছি যে,"অত্যাচার অবিচার আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে
কবি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। যেখানে অত্যাচার সেখানেই
কবির বীণা-ধ্বনি রূপান্তরিত হয়েছে অগ্নি-বীণার বজ্ঞ-বঙ্কারে ; যেখানে
অবিচার সেখানেই কবির বজ্ব-লেখনী গর্জন করে উঠেছে; যেখানে
অন্তায়, সেখানেই কবি-কণ্ঠ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে।
সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধেও কবি ছিলেন সোচ্চার । তিনি মনে-
প্রাণে আশ! পোষণ করতেন যে, দেশে এমন এক শ্রেণীহীন সমাজ
ব্যবস্থা কায়েম হবে, যে সমাজ-ব্যবস্থায় দেশের দরিদ্র জনসাধারণ
শোষক-শ্রেণীর শোষণ হতে মুক্ত হয়ে মানুষের মত জীবনযাপন করতে
পারবে । রুশ বিপ্লবের প্রভাবেই কবির মনে এই সাম্যবাদী চিন্তাধার৷
বিকাশলাভ করেছিল । কিভাবে এবং কখন থেকে তার মনে সাম্যবাদী
চিন্তাধারা প্রবেশ করে সে সম্বন্ধে কল্পতরু সেনগুণ্ত তাঁর 'নজরুল ও
'সুজফফর আহমদ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন ঃ
“..নজরুলের 'ব্যাথার দান-এ লাল ফৌজেয় ও রুশ
বিপ্লবের প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে । এই সমাজ বিপ্লবী প্রেরণ!
তিনি সৈনিক জীবনে লাভ করেছিলেন । সৈনিক ব্যারাকে
তিনি গোপনে রুশ-বিপ্লবের পত্র-পত্রিকা পাঠ করেছেন এবং
অন্যান্যদের পড়িয়েছেন ও আলোচন! করেছেন। ..'সৈনিক
জীবন থেকে ফিরে এসে ( ১৯১৯ সাল খ্রীষ্টাৰ ) তিনি ভারতে
নজরুল
কমিউনিষ্ট পার্টি গঠনের অন্যতম প্রধান 'সংগঠক কমরেড
মুজফফর আহমদের সঙ্গে তার বাড়িতে দীর্ঘদিন বাস করতে
থাকেন। '-*এই সময়ই নজরুলের অধিকাংশ বিখ্যাত রচন।
প্রকাশিত হয়। ছুজনে পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, এবং
গণ-আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন ।৮
এই প্রসঙ্গে মুজফফর আহমদ লিখেছেন £
“১৯২১ সালের শেষাশেষিতে আমরা এদেশে কমিউনিষ্ট
পার্টি গড়ে তুলবো স্থির করেছিলাম । কাজী নজরুল ইসলাম
আমাদের পরিকল্পনায় ছিল। রুশ-বিপ্লরবের উপরে সে যে,
আগে হতে শ্রদ্ধানিত ছিল সে কথা আগেই বলেছি।
আমাদের এই পরিকল্পনা হতেই তার স্বিখ্যাত “প্রলয়োল্লাস”
কবিতা ।৮
“ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর ?--প্রলয় নৃতন স্থজন বেদন !
আসছে নবীন জীবন হারা অনুন্দরে করতে ছেদন !
তাই সে এমন কেশে বেশে
প্রলয় বয়েও আসছে হেসে,
মধুর হেসে!
তিনি আরও লিখেছেন £
“গাহি সাম্যের গান,
মানুষের চেয়ে বড়ে। কিছু নাই ;
নহে কিছু মহীয়ান !
গাহি তাহাদের গান
ধরণীর হাতে দিল যারা আনি
ফসলের ফরমান ।”
গাহি তাহাদের গান
বিশ্বের সাথে জীবনের পথে
যারা আজি আগুয়ান।”
নজরল ৬৭
আর একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন £
“যবে উৎপীড়িতের ব্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না__
বিদ্রোহী রণররাস্ত
আমি সেই দিন হৰ শান্ত 1”
শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শ্রেণীগত ভেদাভেদ কবির মনকে ব্যথিত
করেছে। তাই তিনি লিখেছেন £
“নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ, ধর্মজাতি,
সব দেশ সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জাতি 1
শোষক-শ্রেণীর বিরুদ্ধে তিনি লিখেছেন £
প্রার্থনা করো _যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের ভ্রাণ,
যেন লেখা হয় আমাব রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ |”
কবির মানস নেত্রে ভেসে উঠতো! শ্রেণী হীণ, শোৌষণহীণ এক নতুন
সমাজ। তিনি তাই আবেগ-মথিত ভাষায় বচনা করেন ঃ
“আমর! স্থজিত নতুন জগৎ, আমর! গাহিব নতুন গান 1”
কবি নজরুলের সাম্যবাদী চিন্তাধারা সম্বন্ধে বিখ্যাত বিপ্লবী
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন ঃ
“নিরম্ন, পদদলিত, শোধিত লোকদেরই নিয়া যে ভারতবর্ষ তাহ
পরের যুগের কবির সাহিত্যে আরও পরিস্ষুট হয়। তাই আমরা
কবিকে শৌধিত সর্বহারাদের প্রতিভূরূপে দেখিতে পাই। কবির
বীণায় নৃতন বস্কার ধ্বনিত হয়। তাই তিনি বলিতেছেন £
"সাম্যের গাঁন গাই--
আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোন ভেদাভেদ নাই ।”
এইরূপো তনি “কৃষাণের গান, 'ধীবরের গান+, শ্রমিকের গান,
'সাম্যবাদের গান", "মানুষের গান, প্রদ্থৃতি গান তখনকার নব-প্রতিিত
৬৮ নজকুল
“লালল+ পত্রিকায় প্রকাশিত করেছেন। এই সঈব গানে তিনি গণ
শ্রেণীদের হুঃখের কথা, তাহাদের উপর উচ্চশ্রেণীদের শোষণের কথাও
ওজস্থিনী ভাষায় বর্ণন। করিয়াছিলেন । এই সব গানগুলি আজ সার
বাংলার সম্পত্তি হইয়াছে ।”
শোষক শ্রেণীর প্রতি কবির ছিল অপরিসীম ঘ্বণা। এবং সেই
ঘ্বণারই বহিক্ষুরণ দেখতে পাই তার সাম্যবাদী কবিতাগুলিতে।
পাঠকের অবগতির জন্যে কবির কয়েকটি সাম্যবাদী কবিতা থেকে
কিছু কিছু অংশ এখানে উদ্ধত করা হচ্ছে £
“গাহি সাম্যের গান-_
এখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান ।
যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলীম ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান ।”
“মানুষ” শক কবিতায় নজরুল লিখেছেন £
“গাহি সাম্যের গান-_-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নাই দেশ-কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশ সব কালে ঘরে চরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি 1
“পাপ” ঈর্বক কবিভায় কবি লিখেছেন ঃ
“সাম্যের গান গাই-_
যত পাপী তাগী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই।
এ পাপ মুলুকে পাপ করেনি কো! ঃ কে আছে পুরুষ নারী 1
আমর! তো ছার ;-_-পাপে পঞঙ্কিল পাপীদের কাণ্ডারী ;--
আদম হইতে শুর করে এই নজরুল তক্ সবে
কম বেশী করে পাপের ছুরিতে পুণ্য করেছে যবে 1
বিশ্ব পাপস্থান-্-
অর্ধেক এর ভগবানু, আর অর্ধেক শয়তান ।
নজকল ৬৪
ৰারাঙ্গনার প্রতিও কবির মমতা! অসীম। তিনি তাদের অগুচি
মনে করেননি । তাদের উদ্দেশে কৰি লিখেছেন £
“কে তোমারে বলে বারাগ্না, মা, কে দেয় থুডু ও গায়ে?
হয়তো তোমায় স্তন্ত দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।
নাই হলে সতী; তবু তো তোমরা মাত! ভগিনীরই জাতি,
তোমাদের ছেলে আমাদেরই মতো, তার! আমাদের জ্ঞাতি ॥
*নারী” শীর্ষক কবিতায় কবি লিখেছেন £
“সাম্যের গান গাই-_
আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোন ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু মহান স্থ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক ভার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর |»
“কুল্সি-মজুর? শীর্ষক কবিতায় নজরুল লিখেছেন £
« “দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নীচে ফেলে।
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়৷ মার খাৰে হর্বল ?”
“ফরিয়াদ কবিতার উপসংহারে কবি বলেছেন £
“এবার বন্দী বুঝেছে, মধুর প্রাণের চাইতে ত্রাণ।
মুক্ত কণ্ঠে স্বাধীন বিশ্বে উঠিতেছে একতান-_
জয় নিগীড়িত প্রাণ!
, জয় নব অভিযান !
জয় নব উত্থান!”
এই তো সত্যিকারের কবিতা! এই ছে! সত্যিকারের কবি!
বাবীজন]খ---৫
॥ গীতিকার নজরুল ॥
বিদ্রোহী কবির আর এক পরিচয় হলো! 'গীতিকার+ ও “মুরকার? 1
নিজের লেখা গানৈ নিজেই স্থুর আরোপ করতেন নজরুল। আশ্র্ষের
কথ। এই যে” রবীন্দ্রসঙ্গীতের অমিয়-ধারা যখন তটপ্লাবী নদীজলধারার
মত বাংলা দেশকে প্লাবিত করে প্রবাহিত হচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ই
আর এক নতুন স্রর বঙ্কত হয়ে উঠলে! তরুণ কবি নজরুল ইসলামের
কণ্ঠে - বনফুল আর বাগানের ফুল চয়ন করে গানের পর গান রচনা
করতে লাগলেন গীতিকার নজরুল ।
মুকুন্দ দাস গেয়েছিলেন £
“আ ম গান করিতাম গাইতে দিলে গান।
সে গানে মাতিয়ে দিতাম প্রাণ ।৮
মুকুন্দ দাসের সেই বাসনাকে পরিপূর্ণভাবে রূপ দিলেন নজরুল ।
ৰাংলার প্রতিটি নরনারীর প্রাণ মাতিয়ে দিলেন নজরুল তার অনবস্থ
সঙ্গীত-লহরীতে। গান লিখেছেন অনেকেই। এবং সে সব গান
গাওয়া হয়েছে বিভিন্ন জলসায়, সঙ্গীতের আসরে এবং জন-জমায়েতে।
গ্রামাফোন রেকর্ডেও স্থান পেয়েছে অনেকের লেখা গান ।' কিন্তু
সব গান সর্বশ্রেণীর চিত্ত জয় করতে পারেনি যা! পেরেছিল নজরুলের
গন।
চাষী যুবক মাঠে লাঙল চালাতে চালাতে গাইছে-_“বুলবুলি তুই
ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল” ; বিডি-শ্রমিক বিড়ি বাধতে বাধতে
হলে ত্বলে-_-গাইছে, “কে বিদেশী মন উদাসী বাশের বাঁশি বাজালে
বনে”; প্রেমিক যুবক গুন্ গুন্ করে গাইছে,“চলে নাগরী কাখে গাগরী,
চরণ ভারী, কোমর বাঁকা” স্কুলের ছেলে গাইছে- ণচল, চল, চল,
উত্ব গগনে বাজে মাদল, নিয়ে উতলা ধরণীতল, অরুণ প্রাতের তরুণ
দল, চল্রে চল্রে চল্! কলেজের ছেলে গাইছে-_“হর্গম গিরি কাস্তার
মরু ছুস্তর পারাবার, লভ্বিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রীর! হু শিয়ার ৷”
নজরল ১
দেশ প্রেমিক ছেলেমেয়ের কনে শোনা যাচ্ছে, “ফাসির মঞ্চে গেয়ে
গেল মারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষ্যে দাড়ায়েছে তারা দিবে
কোন্ বলীদান ? ও
স্থরের কী বৈচিত্র্য ! সত্যিই প্রাণ মাতিয়ে তোলে নজরুলেন গান
আর সে সব গানের সুর! আজও মনের ভেতরে $ভসে আসে নজরুল
গতির কথ! আর ন্থুর-_-“এত জল ও কাজল চোখে, পাষাণী আনলে
বল কে? আমারে চোখ ইসারায় ডাক দিলে হায় কে গে দরদী”
“নহে নহে প্রিয় এ নয় আখিজল !” “কেন আন ফুলডোর আজি এ
বিদায় বেলা”, “চেয়ো। না স্ুনয়না, আর চেয়ো না ওই নয়নপাঁনে,»
হিন্দু মুললমান নিবিশেষে বাঙালী তকণরা সেদিন গেয়েছে “দে
জাকাত, দে জাকাত, তোরা দে রে জাকাত”, অথবা “চলরে কাবার
জিয়ারতে, চল্ নাবিজীর দেশ।৮
সত্যা গ্রহী দেশপ্রেমিক তকণ-তরণীর কণ্ে শুনেছি _“কারার ওই
, লৌহ কপাট ভেঙে ফ্যাল কর্ রে লোপাট ; রক্ত জমাট শিকল পুজার
পাষাণ বেদী ।,
আবার অন্ত সবুর, অন্য কথা ঃ “জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত
জালিয়াৎ খেলছে জুয়া !”
হাঁসির গানেও বৈচিত্র এনেছিলেন নজরুল ৷ যেমন 2
“মরি হায় হায় হায়
কুবজার কী রূপের বাহার দেখো;
তারে চিৎ করলে হয় যে ডোঙ৷
উপুড় করলে সাঁকো ।
অথব।-
“কল গাড়ি যায় ভষড় ভষড়
ছ্যাকর! গাড়ি বায় খচাং খচ,
ইচিং বিচিং জামাই চিচিং
কুলকুচি দেয় করে ফচ. ৷
৭ নজরুল
পল্লীনীছিতেও নজরুলের অবদান উল্লেখযোগ্য 1 যেখন £
“কুচস্বরণ কন্যা রে তার মেঘ বরণ কেশ
আমায় নিয়ে যাও রে নদী সেই কন্যার দেশ ।”
কিংবা
“বন্ধু আজে মনে পড়ে আম কুড়ানো খেল *
অথবা--
“গাঙে জোয়ার এলে। ফিরে ভূমি এলে কই ?”
মুদলিম সমাজ এবং মুসলমান ধর্ম সম্বন্ধেও গান রচনা করেছে
নজরুল । যেমন £
«নিখিল ঘুমে অচেতন সহস৷ শুনিন্থ আজান,
শুনি সে তক্বীরের ধ্বনি আকুল হলো মনপ্রাণ,
বাহিরে হেরিন্থ আমি বেহেশ্তী রৌশনীতে রে
ছেয়েছে জমীন ও আসমান;
আনন্দে গাহিয়৷ ফেরে ফেরেশতা ছুর সোলেমান---
এলো কে-কে এলে ভূলোকে
হুনিয়া ছুলিয়। উঠিল পুলকে 1”
এবং"
“ত্রাণ করমওলা মদিনার-.
উন্মত্ত তোমার গুনাহগার কাদে
তব প্রিয় মুসলিম ছুনিয়ার
পড়েছে আবার গোনাহের ফাদে ।”
আঅথবা-..
“নীল সিয়া আসমান লালে লাল ছনিয়া_
আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া
কাদে কোন্ ভ্র্দসী কারবালা' ফোরাতে,
নজরুল 9৩
রুদ্র মাতন ওঠে ছুনিয়া-_দামেশকে'-
জয়মালে পরালে এ খুনিয়ার বেশ কে?
“হায় হায় হোসেন' এ রোল ওঠে ঝায়
তলওয়ার কেঁপে ওঠে এজিদের পাতায় ।”
শ্ছাড়াও আছে, যেমন-_
“হ্ষমন্ লোনু ঈষায় নীল
তব তরঙ্গে করে ঝিল মিল;
বাকে বাকে রোষে মোচড় খেয়েছে
গীয়ে নীল খুন পিগারীর ।
জিন্দা বীর
ভুলফিকার আর হায়দারী হাক হেথা আজো হজরত আলীর
সাতিল আরব। সাতিল আরব !! জিন্দ। রেখেছে তোমার ত'র |”
হিন্বুৰ দেব-দেবীকে নিয়েও কবিতা ও গান রচনা করেছেন
নজরুল । যেমন £
“আর কতকাল থাকবি বেটী
মাটির ঢেলার মৃতি আড়াল!
স্বর্গ যেআজ জয় করেছে
অত্যাচারী শক্তি চাড়াল !”
এবং
“ম] যে আমার কেবল জ্যোতি
সেই পরম শুভ্র জ্যেতিরধারায়
নিখিল বিশ্ব যায় ডুবে যায় 1”
হিন্দুর উপাস্য দেবীকে আর কোন মুসণমান কবি এভাবে “মা”
বন্দে ভাকেননি। কিন্তুধর্ম এবং জাতির গণ্ডী দিয়ে নজক্ুলকে কেউ
আলাদ। করে রাখতে পারেনি ৷ তিনিছিলেন সমস্ত গৌঁড়ামির উর ।
সাই দেশমাতুক আর জগজ্জননী হর্গাকে তিনি একাকার করে মায়ের
জাসদ বসিয়ে স্বতি করেছেন।
শু নজরুল
গীতিকার নজরুলের কথা বলতে গিয়ে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
বলেছেন £
“অনেকের ধারণ! বিদ্রোহী কিংবা যোদ্ধার গলায় প্রেমের
কথা ঠিক মানায় নং। খুবই ভুল ধারণা। যোদ্ধারাই
সম্ভবতঃ শ্রেষ্ঠ প্রেমিক । পৃথিবীর যাবতীয় মহাকাব্য তার
প্রমাণ দেবে।
মাস কয়েক আগেকার কথা । রেডিয়োতে “বঙ্গ আমার
জননী আমার” অনুষ্ঠানে নজরুল গীতি শুনছিলাম । ছু'রকমের
গানই সেদিন গাওয়া হল। বীরত্বব্যঞ্জক এমন গান, যা শুনলে
কাপুরুষের রক্তেও আগুন ধরে যায়। তার পাশাপাশি এমন
মিঠে গজল, য৷ শুনলে বীরপুরুষের চক্ষুও একটি ললিত স্বপ্নের
নেশায় আপনা! থেকেই বুজে আসে । এই হল নজরুলের
ষোল আনা পরিচয়। আট আনা বিদ্রোহ, আট আনা
ভালবাসা ।
নীরেনবাবু নিজে কবি, তাই নজরুলের কবিসন্তাকে তিনি
সঠিকভাবে ধরতে পেরেছেন। নীরেনবাবুর সঙ্গে ক মিলিয়ে
আমরাও বলছি--নজরুল একাধারে বিদ্রোহী এবং প্রেমিক;
দেশপ্রেমিক এবং ভক্ত--তাই তার এক হাতে কগ্রবিষাণ, অশ্তহাতে
মোহনবীশি ; এক হাতে তলোয়ার, অগ্কহাতে ফুলের মাল! ।
॥ জীবন-সায়াহে ॥
কবি নজরুলের জীবনে আজ ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যার
কালে! যবনিকা। কবি আজ আমাদের মধ্যে থেকেও মেই। বাংলার
বুলবুল আজ নিস্তন্ধ। বাঙালীর এ যে কতপড় ছঃখ তার তুলন!
নেই। আজ আর কেউ কম্ুককণ্ঠে বলে না--“দে গরুর গ! ধুইয়ে !*
নজ%ল ৭৫
বাংলার প্রিয় সম্তান নজরুলের স্মৃতিশক্তি আজ রুদ্ধ হয়ে গেছে।
জানি না, আর কোনদিন তা ফিরে আসবে কি না! হয়তে। আসবে ।
যেমন হঠাৎ একদিন তা এসেছিল কয়েক মূহুর্তের জন্যে । সেদিনের
সেই শ্মরণীয় মুহুর্তগুলিকে ভাষায় রূপ দিয়ে অমর করে রেখেছেন
সাহিত্যিক শ্রীস্থনীল গঙ্গোপাধ্যায় । পাঠক-পাঠিকার অবগতির জন্যে
সুনীলবাবুর সেই রচনাটি এখানে হুবন্থ তুলে দিলাম।
“দে গরুর গ৷ ধুইয়ে !
আমি একেবারে সর্বাঙ্গ চমকে উঠলুম। প্রচণ্ড হুঙ্কার
দিয়ে কবি গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসে স্বাভাবিক চোখ
মেলে তাকার্পেন। তারপর বিরক্তি মেশানে। গলায় বললেন,
একি! এতো! মাল! টাল! দিয়ে এমন জবরজং করে সাজিয়েছ
কেন আমায় ? কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে আমায় বলি দেবে নাকি ?
এতো €বলা হলো, চা-টাও দেয়নি, ক্ষিদে পেয়ে গেছে।
কালী কুল দে মা, নুন দিয়ে খাই, ও:র, চা-টা দিবি নাকি ?”
আমার তখন আনন্দ বিম্ময়ে চুড়ান্ত অবস্থা ।
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম এইমাত্র জ্ঞান ফিরে পেয়ে সুস্থ
হয়ে উঠলেন, আমারই চোখের সামনে । তার চোখে-মুখে আগেকার
সেই বিখ্যাত তেজ ও উজ্জ্বলতা । সার! দেশের লোককে এ নুসংবাদ
আমিই প্রথম জানাবো, এই আনন্দে আমারই তখন উন্মাদ হয়ে
যাবার মতন অবস্থা ।
কবির জ্ঞান ফিরে আসবার পর প্রথম ইণ্টারভিউ ছাপাবার
কৃতিতও আমার । *
কবি এখন হাসিমুখে গল! থেকে মালাগুলো খুলে ফেলেছেন এবং
গুনগুন করে গান করছেন--বাগিচার বুলবুলি তৃই ফুল শাখাতে
দিসনে আজি দোল।-_সেই ভরাট প্রাণবস্ত কণ্ঠস্বর । আমি পকেট
থেকে খাত! পেন্সিল বার করছিলুম, তিনি আমাকে এই প্রথম লক্ষ্য
করে ধমকে বললেন, “এই ছ্রোড়া, ভূমি এখানে কি করছে! ? জ্যা 1
গড
আমি থতঙ্ত খেয়ে বললুয়, «কছু না, মানে একটা অটোগ্রাফ
দিতে এসেছি, আর যদি হু'লাইন কবিতা লিখে দেন ।”
-_-“এধন হবে না। যাও ভাগো ! অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাত
বাথ! হয়ে গেকো?, আবার কবিতা? হবে না, অটোগ্রাফ নেবে তে
€ময়েরা, তোমার দরকার কি হে? এখন সময় নেই ।”
আমি তবু চুপ করে বসে রইলুম, নজরুল আপন মনেই বললেন
--+*ইস্, এতো! দেরী হয়ে গেলো! নেপেনকে নিয়ে পণ্ডিচেরী যাবার
কথ! ছিলো, শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে দেখা করবো-_?
আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, “নৃপেন্দ্রকষ্চ চট্টোপাধ্যায়ের কঞ্চ
বনছেন ?”
হ্যা । চেনো নাকি ?”
“আজ্ঞে চিনি। কিন্ত তিনি তে! বেঁচে নেই । শ্রীঅরবিন্দও।”
-_-শা, নেপেন বেঁচে নেই ? কি বলো? কবে মরলো ? আঙি
তখন কোথায় ছিলাম ?”
কবিব গলায় অসহায় আর্তনাদ ফুটে উঠলো । মানুষকে হঃখেক্স
খঘর শোনাবার অভ্যেস আমারও নেই । আমিও খানিকটা অসহায়
€ধাধ করতে লাগলুম । তবু মৃহস্বরে বললুম, “আপনি একটান!
অনেকদিন ঘুমিয়েছিলেন । অ-নে-ক দিন। এর মধ্যে অনেক কিছু
বদলে গেছে। দেশ হ্বাধীন হয়েছে--”
- শ্হয়েছে 1? গেছে সাহেব ব্যাটার? কারার এ লৌহকপাট
জিতেছে? সত্যি? তাহলে তো ফুতি করতে হয় আজ। পগণ্ডিচেরী
থাক। তাহলে আজ অচিস্ত্য আর প্রেমেনকে ডেকে একবার ঢাক'
ঘুরে আসি, ওখানে বুদ্ধদেব আছে ।”
আমি বললুম, “বুদ্ধদেব বনু ঢাক! ছেড়েছেন বছদিন। তাছাড়া,
পাকিস্তান-*।
- “পাকিস্তান? হক সাহেবের সেই পাকিস্তান ? হাহা
হারহাঠ! জ্জন্না-গান্ধীজীর ঝগড়। জাজও মেটেনি ?”
নন গণ
- প্ঝীগড়া মিটেছে কি না জানি না, ঘবে ওর! কেউই আর
ইহলোকে নেই 1
--“নেই ? তবে পাকিস্তান কি জন্কে 1
পাকিস্তান ওঁরা বেঁচে থাকতেই হয়ে গেছে। পূর্ব বালা,
পশ্চিম পাঞ্জাব আর সি্ধু নিয়ে পাকিস্তান হয়েছে অনেকদিন আগে ।
গত বছর ওদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধও হয়ে গেলে! ।”
-যুদ্ধ হয়ে গেলে! মানে? পূর্ব বাংলার সঙ্গে পশ্চিম বাংলা
যুহ্ধ করবে? তুমি কেহে ছোকরা? সত্যি করে বলতো? বৃটিশের
স্পাই নও তো ?”
আমি বিষ হেসে বললুম, “পূর্ব বাংলার সঙ্গে আমাদের হাতা-
হাতি যুদ্ধ হয়নি বটে, কিন্তু এটা একট! আলাদ! দেশ। ওখানকার
সঙ্গে এখানকার যাতায়াত বন্ধ, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, এমনকি বইপত্রের
বিনিময়ও বন্ধ। এখানকার বই ওরা পড়তে পায় না, ওদের বইও
আমরা পাই না।
“এরা আর ওর? তুমি এখান থেকে ভাগে তো! যতো
সব মিথ্যে কথা শোনাতে এসেছো । আমি আজকের ট্রেনেই ঢাকা
যাবো। দেখি কে আমায় আটকায়! আমি জসিমউদ্দিন, গোলাম
মুস্তাফা, প্রেমেন, শৈলজাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো । ওখান থেকে অজিত,
পরিমল, মোহিতলালকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবো । দেখিকেকি করে?
ভূমি এধন সরে পড়ো।”
আমি বললুম, “আপনি আমার ওপর অকারণে রাগ করছেন ।
কিন্ত কথাগুলে। সত্যি । আপনি ষে ট্রেনে চাপবেন, সে রকম সরাসরি
কোন ট্রেনই চলে না আজকাল আর। ওদেশের সঙ্গে আমাদের
দেশের যোগাযোগ সত্যিই একেৰারে ৰন্ধ। আর ধাদের নাম করছেন
ভারা অনেকেই দেশ ছেড়েছেন। অবশ্ট আপনি যদি যেতে চান
ভাহলে ছুই সরকারের মধ্যে লেখালেখি করে একটা কোন
বন্দোবস্ত...
৭৮ নজরুল
কবি এবার খানিকট! হতাশ চোখে তাকালেন । * দীর্ঘনিশ্বাস
ফেলে বললেন, “এতদিন সত্যিই ঘ্ুমিয়েছিলুম, তুমি শুধু আমায় খারাপ
খবর শোনাচ্ছে! । ভালো খবর কিছু নেই %
আমি চিস্তিতভাবে বললুম, “ভালো খবর? হ্যা, মানে, এই তো
হর্গাপুরে বিরাট ইস্পাত কারখান। হয়েছে । কলকাতায় অনেক বড়
বড় বাড়ি উঠেছে. *.৮
তাকিয়ে দেখি কবি আব।র অবসন্নভাবে হেলান দিয়েছেন। কি
সব বিড় বিড় করতে করতে হাত দিয়ে মাথার চুলগুলি ছি ডছেন ।
স্বনীলবাবুর চোখের সামনেই কবি আবার হারিয়ে গেলেন।
ক্ষণপ্রভার মত যে স্মৃতিরেখা হঠাৎ চমকে উঠেছিল, আবার ত বিলীন
হয়ে গেল।
কিন্ত আর কি কোনদিন কবির সে স্মৃতিশক্তি ফিরে আসবে না!
আবার কি হঠাৎ জেগে উঠে তিনি বলবেন না-_-“দে গরুর
গা ধুইয়ে !”
জীবনানন্দ
॥ জীবনানন্দের কবিসত্বা ॥
রবীন্দ্রযুগের কবি হয়েও যে ছু'জন কবি রবীন্দ্র-প্রভাব হতে মুক্ত
থেকে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বকীয়তায় উজ্জল হয়ে রয়েছেন, তাদের
একজন হলেন কবি নজরুল এবং অপরজন হলেন কবি জীবনানন্দ
দাশ।
ইতিপূর্বে নজরুলের জীবনকথা! লিখতে গিয়ে আমর! তার কবিতা
সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচন। করেছি । এবার জীবনান্দের কবিত। সম্বন্ধে
কিছু বলছি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমান গ্রন্থটি মুখ্যত রবীন্দ্রনাথ,
নজরুল, এবং জীবনানন্দের সংক্ষিপ্ত জীবনী হিসেবে লেখ! হলেও
কবিদের জীবনী, বিশেষ করে সুবিখ্যাত কবিদের জীবনী লিখতে
গিয়ে যদি শুধুমাত্র গতানুগতিক ধারায় আলোচ্য ব্যক্তির বংশ”
পরিচয়, জন্ম, বাল্যকাল, শিক্ষা এবং কর্মজীবন সম্বন্ধে আলোচনা
করা হয়, তাহলে সে রচনা হবে স্কুলপাঠ্য রচনা! বই-এর মনীষীদের
জীবনীর মত নীরস। আমাদের মতে কবি ও সাহিত্যিকদের জীবন-
“কথ! লিখতে হলে আলোচ্য কবি অথবা সাহিত্যিকের কবিতা
এবং সাহিত্য নিয়েও আলোচনা করা দরকার; কারণ কবি ও
সাহিত্যিকদের ব্যক্তিসত্বার সঙ্গে তাদের কবিসত্বা এবং সাহিত্য
ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে । তাই কবির জীবনকথা আলোচন।
করতে হলে তার কবিত! সম্বন্ধেও আলোচনা কর! দরকার ; নইলে
কবির সম্পূর্ণ পরিচয় প্রকাশ করা যায় না।
নজরুলের জীবনী আমসোচনার সময় আমরা এই পদ্ধতিই
অবলম্বন করেছি। জীবনানন্দের বেলাতেও তাই আগে তাঁর কবিতা!
নিয়ে আলোছন! করছি।
৮০ | জীবনানন্দ
কবি জীবনানন্দ দাশকে বলা হয় আধুনিক কবিতার অগ্রদূত ।
নতুন সুর এবং নতুনতর আঙ্গিক লক্ষ্য করা যায় জীবনানন্দের প্রতিটি
কবিতায় । উদাহরণ হিসেবে বাংলা দেশ (অখণ্ড বাংলা দেশ)
সম্বন্ধে তার নতুন অনুভূতির উল্লেখ করা যায়। স্িদ্ধা, শ্তামল! বাংলা
মায়ের রূপের তুলনা! ছিল না কবির লেখায়। জীবনানন্দের বাংল৷
তাই 'রূপসী বাংলা । এই নতুন অনুভূতির ফলেই তিনি দেখতে
পেয়েছিলেন বাংল মায়ের সত্যিকারের রূপ । এবং সে রূপকে তিনি
প্রকাশ করেছেন স্বকীয় ধারায় । তিনি লিখেছেন £
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি
তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে চাই না আর;
অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছ
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড় পাতাটির নিচে বসে আছে
ভোরের দোয়েল পাখি-_
চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের ভূপ
জাম-বট-কাঠালের-হিজলের-অশথের করে আছে চুপ ঃ
ফনিমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে
কী সুন্দর! কী প্রাণবস্ত এই রচনা ! পল্লী-বাংলার এই রূপটিই
হলো! বাংলার আসল রূপ। গগনচুম্বী হর্মমালা-শোভিত শহর-বাংলার
শুক রূপ এটা নয়; এরূপ হলো! শ্যামলা, কোমলা, অপরূপা! বাংল!
মায়ের নিগ্ধ-নুন্দর রূপ ।
এই অন্ুভূতিরই প্রকাশ দেখা যায় জীবনাৰন্দের আর একটি
কবিতায় ; তাতে তিনি লিখেছেন £ ূ
“আকাশে সাতটি তারা খন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে,
বসে থাকি, কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মত
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে-_-আসিয়াছে শান্ত অনুগত
বাংলার নীল সন্ধ্যা--কেশবতী কন্তা যেন এসেছে আকাশে,
জীবনানন্দ ৮১
আমার চোখের 'পরে আমার মুখের *পরে চুল তার ভাসে ;
পৃথিবীর কোন পথ এ কন্তারে দেখিনিতো-_দেখি নাই অত
অজত্র চুলের চুম! হিজলে কাঠালে জামে ঝরে অবিরত
জানি নাই এত স্সিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুক্রে বিশ্বাসে ।”
বাংলার এই অপরূপ রূপট কবি দেখেছিলেন নদী-মাতৃক বাংল!
দেশের বরিশাল জেলার কোন এক নদীর তীরে ঘাসের ওপর বসে।
সন্ধ্যাবেল! স্টীমার, লঞ্চ এবং ছোট ছোট নৌকাগুলি যখন ঢেউয়ের
পাতিছন্দের সঙ্গে তাল রেখে নদীর বুকে শিহরণ জাগাতো, তখন
উমিমালার নাচন দেখে কবি তন্ময় হয়ে যেতেন। তাকিয়ে থাকতেন
অনিমেষ নয়নে বাংলার উদার আকাশের পানে ধ্যানমগ্ন খষির
মত।
ৰাংলাকে কবি কতখানি ভালবাসতেন, তার পরিচয় পাওয়া যায়
কবিজায়! লাবণ্য দাশের লেখা থেকে । শ্রীমতী দাশ লিখেছেন £
“..*বাংলার কবি-_বাংলার মাটি, জল, বাংলার সেহনীড় ছেড়ে
বেশীদিন দূরে থাকতে পারবেন না। পারবেন না তিনি হিজলের
অশখের লবৃুজ আভ! ছড়ান বন, বেলঝুঁড়ি ছাওয়া পথ, সিদ্ধ
মলয় হিল্লোলিত কাশের বন আর কোকিলের কুহুতান ছেড়ে
দূরে থাকতে, তাই তো! তিনি সকলকে বার বার আশ্বাস দিয়ে
গিয়েছেন £
'আবার আসিব ফিরে ধানসিডিটির তীরে এই বাংলায়
হয়তে। মানুষ ময়-_-হয়তো! বা শঙ্খচিল শালি খর বেশে ;
হয়তে! ভোরের কাক হয়ে এই কাতিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার টি তেসে একদিন আসিব এ নী ছায়ায় ।
যো বা হী হযো কিশোরীর গু হিতে লাল পা,
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে-ভেসে
৮২ জীবনানম্্
, আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা! বাংলার এ সবুজ করুণ ভাঙায়।
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে ;
হয়তো! শুনিবে বক লক্ষ্ীপ্রচা ডাকিতেছে শিমূলের ভালে ;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে ;
রূপসার ঘোলজলে হয়তো! কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিডা বায় ;__-রাঙা মেঘ সাতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক ; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে-_”*
নী সঃ রা
কবি ছিলেন প্রকৃতির পৃজারী। উদার নীল আকাশ, কাশের
বন, হিজলের, নারকেলের সবুজ পাতা তাকে হাত ইশারায় ডাক
দিত। ৃর্ষের প্রখর আলোঁকরেখাটি যখন আকাশের বুকে সোনালী
রং একে দিত অথবা তার অতি আদরের অজস্র ফুলে ভরা গন্ধরাজ
ফুলের গাছটিকে র-এ ভরিয়ে তুলত, কবি তখন বাগানে একখানি
ইজি চেয়ারে আধশোয়৷ অবস্থায় সেই সৌন্দর্যনেশায় বিভোর হয়ে
থাকতেন । কখনও বা সুদূর দিগন্তের পানে অবাক দৃষ্টি মেলে ধীরে
ধীরে উচ্চারণ করতেন-_
রৌদ্র-ঝিলমিল
উষার আকাশ ।
অপার এই্বর্যবেশে দেখ! তুমি দাও বারে বারে।
এই সৌন্দর্যের অন্ুভূতিই নানাভাবে নান! ছন্দে রূপ নিয়েছে
ভার বিভিন্ন কবিতায়। এই অনুভূতির পথ ধরে চলতে চলতেই
চিনতে পেরেছিলেন তিনি শ্যামলা, কোমলা, অপরূপ বাংল! মায়ের
নিজন্ব রূপটিকে ।” |
* কবিকে যখন কর্মোপলক্ষো বাংলা দেশের বাইরে যেতে হয়েছিল সেই
সময়, অর্থাৎ বাংল। দেশ ছেড়ে বাইরে যাবার গ্রান্কালে, এই কবিতাটি তিনি
লিখেছিলেন।
জীবনানন্দ ৯৩
কবির এই অনুভূতিকে সঠিকভাবে, চমৎকারভাবে প্রকাশ করেছেন
কবি-জায়া। এমন সুন্দরভাবে জীবনানন্দের কবিসত্বাকে প্রকাশ করা
একমাত্র তার দ্বারাই সম্ভব হয়েছে ; কারণ তিনি নিজেকে একেবারে
একাকার করে দিয়েছিলেন কবির জীবনের সঙ্গে ।
কবিসত্বার আর এক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে পাকিস্তান স্থার্টির
প্রাকালে রচিত তার একটি কবিতায়। এই প্রসঙ্গে শ্রীমতী লাবণ্য
দাশ লিখেছেন
“কবির বাল্য ও কৈশোরের ন্মৃতিঘেরা বরিশাল ।
সেখানে দেখেছেন তিনি হিন্দু-মুসলমানের অপূর্ব ভ্রাতৃরূপ।
খে বিপদে একে অপরের পাশে দাড়িয়েছে স্নেহ,
ভালবাসায় হয়ে উঠেছে অতি আপনজন ।**
কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পূর্ব-মুহূর্তে একই মায়ের কোলে
ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি, তাদের সে রক্তের হোলিখেল৷
বেদনায় মুক করে তুলেছিল কবিচিত্তকে-_বিষাদে আচ্ছন্ন
করেছিল তার প্রাণ। অন্তরের সে ব্যথা সে বেদনাকে মুখে
প্রকাশ করবার ভাষ! তিনি খুঁজে পাননি । তাই লেখনীর
সাহায্যে গেথে রেখে গেছেন ভাবীকালের সম্ভানদের পথ
দেখাবার জন্তে-_
“প্রকৃতির পাহাড়ে পাথরে সমুজ্জল
ঝর্নার জল দেখে তারপর হ্বদয়ে তাকিয়ে
দেখেছি প্রথম জল নিহত প্রাণীর রক্তে লাল
মানুষ খেয়েছি আমি তার রক্তে আমার শরীর
উ'রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
ভাই আমি ; আমাকে সে কনিষ্টের মতো জেনে তবু
হদয়ে কঠিন হ'য়ে বধ করে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর
কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজ প্রতিম বিষুঢুকে
৮৪ | জীবনানক্
বধ ক'রে ঘুমাতেছি--তাহার অপরিসরবুকের ভিতয়ে
ঘুমাতেছে।
যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হয়ে
ব'লে যাবে কাছে এসে । “ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ, মকবুল, করিম, আজিজ-_
আর তুমি ? আমার বুকের “পরে হাত রেখে
মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে শুধাবে সে-_রক্ত নদী উদ্বেলিত হ'য়ে
ব'লে যাবে, গগন, বিপিন, শশী পাথুরেঘাটার ;
ম'নিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফীটের, এ্টালীয
অখণ্ড অনস্তে অস্তহিত হয়ে গেছে;
কেউ নেই, কিছু নেই - সূর্য নিভে গেছে ।'ঃ
এই জীবনানন্দ । বাংলার কবি, বাঙালীর কৰি জীবনানন্দ ।
হত, উদার, অতুলনীয় জীবনানন্দ ।
সঃ ঙ্ রী
গ্রবার বলছি কবির লেখা ভিন্ন ত্বাদের কবিতার কথা।
এখানেও শ্রীমতী লাবণ্য দাশের রচনার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা হচ্ছে।
শ্রীসতী দাশ লিখেছেন £
"ভগবানের স্ষ্ট শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ । পৃথিবীর আলোর
চোখ মেলে-_এখানকার শোভা সৌন্দর্য ছ'চোখ ভরে দেখবার
জন্য, জীবনকে পরিপূণ্ভাবে উপভোগ করবার জন্তই সে
পৃথিবীতে এসেছে । কিন্তু সব কিছুই তার কাছে ব্যর্থ ৰলে
মনে হয় কেন? জীবনকে বোঝা মনে করে তাকে দূরে ফেলে
দেবার জন্ত কেন সে ব্যস্ত হয়ে ওঠে ?
জীবনানন্দ ৮৫
এই সব চিস্তা কবির মনে উদিত হয়েছে লাসকাটা ঘর্
দেখে । বরিশালের সযত্বে, অবহেলায় পড়ে থাক লাসকাটা
ঘর। মানুষের অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে সে যেন
লজ্জানত শিরে নীরবে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছে। প্রিয়ার
বুকভরা ভালবাসা, শিশুর অনিন্দযস্ুন্দর হাসি, খ্যাতি,
মান, প্রতিপত্তি, জীবনের পরিতৃপ্তি, সবকিছুই হেলায় ঠেলে
ফেলে দিয়ে এহেন ঘরে গিয়ে যে মানুষ তার বুকের জ্বালা
জুড়াতে চায়, দূর করতে চায় তার অবসাদ, অপরিসীম ক্লাস্তি
_কি তার ব্যথা! কোন্ সে মর্মস্তদ হঃখ !
এই চিন্তার প্রতিফলনই দেখতে পাওয়! যায় লাসকাটা ঘরের
সম্বন্ধে কবির লেখ বিখ্যাত কবিতায়, যাতে তিনি লিখেছেন ঃ
“শোন! গেল লাসকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে ;
কাল রাতে-_ফাল্তনের রাতের আধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাদ
মরিবার হলো তার সাধ ;
বধূ শুয়েছিল পাশে--শিশুটিও ছিলো ;
প্রেম ছিলো, আশা ছিলো-_-জ্যোত্নায় তবু সে দেখিল
কোন্ ভূত? ঘুম ভেঙে গেল তার ?
অথব। হয়নি ঘৃম বহুকাল লাসকাটা ঘরে
শুয়ে ঘুমায় এবার ।
এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি ?
কোনদিন জানিবে না আর
জানিবার গা বেদনার
অবিরাম--অবিরাম ভার,
সহিবে না আর--
রবীজনাখ--»
৮৬ 'জীবনানন্দ
জীবনের এই স্বাদ-স্থপক্ক যবের আগ ,
হেমস্তের বিকেলের
তোমার অসহা বোধ হলো;
মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো
মর্গে_গুমোটো
খ্যাতা ই'ছরের মতো রক্তমাঁথা ঠোটে ।
জানি--তবু জানি
নারীর হাদয়__প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি ;
অর্থ নয়, কীতি নয়, সচ্ছলত। নয়-_-
আরো! এক বিপন্ন বিশ্যয়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে
আমাদের ক্লাস্ত করে
ক্লাস্ত- ক্লাস্ত করে ;
লাসকাটা ঘরে ।
সেই ক্লান্তি নাই ;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিত হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে |:
সু গু গা
জীবনানন্দের কবিতায় আছে ভাবের রঙ। বর্ণ-বিশ্বাসী কৰি
তিনি। তাই সহজেই তিনি রঙ দেখতে পান। যেমন ঃ
“যেখানে রূপালী জোসনা ভিজিতেছে শবের ভিতর,
সেখানে অনেক মশ! বানায়েছে তাহাদের ঘর ;
যেখানে সোনালি মাছ খুঁটে খুঁটে খায়
সেই সব নীল মশা! মৌন আকাঙ্জায় ;
জীবনানন্দ ৮৭
নির্জন মাছের রঙে সেইখানে হ'য়ে আছ চুপ
পৃথিবীর এক পাশে একাকী নদীর গাট রূপ ;
কাস্তারের একপাশে যে নদীর জল
বাবল! হোগল! কাশে শুয়ে শুয়ে দেখিছে কেবল
বিকেলের লাল মেঘ ; নক্ষত্রের রাতের আধারে
বিরাট নীলাভ খোঁপ! নিয়ে যেন নারী মাথা নাড়ে
পৃথিবীর অন্ত নদী ; কিন্তু ওই নদী
রাঙা মেঘ-_হলুদ হলুদ জ্যোৎসস। ; চেয়ে ছ্যাখো যদি ।
অন্ত সব আলো তার অন্ধকার এখানে ফুরালো ;
লাল নীল মাছ মেঘ- ম্লান নীল জ্যোতসার আলো
এইখানে ; এইখানে যুণালিনী ঘোষালের শব
ভাসিতেছে চিরদিন ; নীল লাল রূপালী নীরব |”
বর্ণ-অন্বেবী কবির বর্ণবৈচিত্র্য ফুটে উঠেছে আরও অনেক
কবিতায়। যেমন ঃ
“ভালে বলিয়াছি আমি রাঙ। রোদ ক্ষান্ত কাতিকের মাঠে ঘাসের আচলে
ফড়িঙের মতে! আমি বেড়ায়েছি, দেখেছি কিশোরী এসে হলুদ করবা
ছিড়েনেয়--বুকে তার লাল-পেড়ে ভিজে শাড়ি করুণ শঙ্খের মতো ছবি
ফুটাতেছে ; ভোরের আকাশখানা রাজহাঁস ভরে গেছে নব কোলাহলে
নব নব শ্চনায় $ নদীর গোলাপী ঢেউ কথা বলে-__তবু কথা বলে,
তরুজানি তার কথ কুয়াশায় ফুরায় না_কেউ যেন শুনিতেছে সবি
কোন্ রাঙ। শাটিনের মেঘে বসে-_
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, জীবনানন্দের কবিতা চিত্ররূপময়। সত্যিই
বিচিত্ররূপে, বিচিত্র বর্ণে, বিচিত্র ব্বাদে চিত্রিত হয়েছে জীবনানন্দের
চিত্ররূপময় কবিতারাজি, যেমন
«কচি লেবু-পাতার মতে! নরম সবুজ আলোয়
পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেল। ;
৮৮ জীবনানন্দ
কীচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস তেমনি স্ুপ্রাণ-
হরিণের দাত দিয়ে ছিড়ে নেয়!
আমারে! ইচ্ছা করে ওই ঘাসের ভ্রাণ হরিৎ মদের মতো
গেলাসে গেলাসে পান করি,
এই ঘাসের শরীর ছানি-_চোখে চোখ ঘষি,
ঘাসের পাখনায় আমার পালক,
ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো! এক নিবিড় ঘাস-মাতার
শরীরের সুন্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে ।”
আর একটি কবিতায় দেখা যায় ঃ
“বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ..-ৰৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;
নীল।ভ নোনার বুকে ঘন রস গাঢ় আকাজ্ষায় নেমে আসে ;
কিংবা
“ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে
অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘ্বণা করে দেখিয়াছি মেয়েমান্ুষেরে 1৮
রর চি ও
এই আখ্যায়িকার প্রারস্তে আমর! বলেছি যে, জীবনানন্দ দাশ
রবীন্দ্রযুগের কবি হলেও তার কবিতা রবীন্দ্র-প্রভাব হতে মুক্ত। কিন্ত
রবীন্দ্র-প্রভাব হতে মুক্ত হলেও তাঁর কোন কোন কবিতায় পাশ্চাত্য
প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত কবিতায় শেকৃস্লীয়র এবং আরও কয়েকজন
রোমান্টিক পাশ্চাত্য কবির রচনার ছায়। বেশ সুস্প্ হয়ে দেখ দিয়েছে।
কবির “অবসরের গান' বাঙীলী জীবনের সত্যিকারের অবসরের গান।
প্রস্থৃতি মাটি, ফলস্ত ধান আর ভিজে শৈশবের গন্ধ দিয়ে ভরা । অথট,
এই হ্বরস্থায়ী অবসরের অস্পষ্ট সৌন্দর্যচ্ছায়াকে চিত্তরন্ধ.করবার জন্টে
কবি মাষে-মাধেই সাহায্য নিয়েছেন পরিচিত হিদিী ইবিনৈতজির,
জীবনানন্দ . ৯৪
বিদেশের রীতিনীতি কিংব প্রচলিত কাহিনীর । এতে অবশ্য কাব্যের
রস গাঢ়ই হয়েছে ; সমৃদ্ধ হয়েছে কবির বস্তব) £
“এখানে শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপর মাথা পেতে,
অলস গেঁয়োর মতে৷ গ্রইখানে কান্তিকের ক্ষেতে 7৮
এই ক্ষেত নিঃসন্দেহে রূপসী বাংলার ক্ষেত, “রূপ যার শীগগিরই
যাবে ঝরে',_“যখনই শীত এসে নষ্ট ক'রে দিয়ে যাঁবে তারে? । কিন্তু
“মাছির গানের মতো অনেক অলস শবে কান ভরে অবসর পাওয়া
কবির মনে বিচিত্র সাধ জাগে £
গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন্ ভাড়
বেঁধেছিল ছড়া !
তার সব কবিতার শেষ পাঁত। হবে আজ পড়া ;
ভুলে গিয়ে রাজ্য-__জয়-_সাম্রাজ্যের কথা
অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাক! ছিলো, তুলে নেবো
তার শীতলত। ;
ডেকে নেবো আইবুড়ো! পাড়ার্গায় মেয়েদের সব ;
মাঠের নিস্তব্ধ রোদে নাচ হবে-__
শুরু হবে হেমন্তের বরফ উৎসব |”
গাছের ছায়ার তলে ছড়া বেঁধেছিল যে ভাড়টি, সে শেকস্গীয়রের
স্ষ্ট জ্যাক ছাড়া আর কে হবে? আর্ডেনের বনে সেই তো! ভাগ্য-
দেবীর চপলত। নিয়ে মনের হৃঃখে গান বেঁধেছিল !
আবার “অনেক মাটির তলায় চাপা পড়ে ঠাণ্ডা হওয়া মদ
নাইটিংগেল-এর গীতমুগ্ধ কীট্সের কল্পিত রক্তিম লফেন সুরার পাক্জটি
ছাড়া আর কী-ই ব। মনে পড়িয়ে দেয়।”
[ জীবনানন্দ কাব্যে পাশ্চাত্য গ্রভাব £ ডঃ স্থপ্তি সেম ]
. জীবনানন্দকে অনেকে রোমার্টিক কবি বলে থাকেন; কারণ
সর কবিতায় রোমান্স কুটে উঠেছে অনিন্্যনুদ্দররূণে ; মেষন £
জীবনানন্দ
“তাই আমি প্রিয়তম ;_ প্রিয়! বলে জড়ায়েছি বুক-_
ছায়ার মতন আমি হয়েছি তোমার পাশে গিয়া !
যে ধুপ নিভিয়া যায় তার ধোয়া আধারে মিশুক,
যে ধোয়া মিলায়ে যায় তারে তুমি বুকে তুলে নিয়
ঘুমানে। গন্ধের মতো৷ প্র হয়ে তার ঠোটে চুমো দিও) প্রিয়া !”
জীবনানন্দের কবিতায় বাস্তবতাবৌধও অতুলনীয় ; যেমন £
“মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব
থেকে যায় ; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
প্রথমত চেতনার! পরিমাপ নিতে আসে 1”
অথবা-_
“ভোরের স্টিক রৌদ্দে নগরী মলিন হয়ে আসে।
মানুষের উৎসাহের কাছ থেকে শুরু হলো! মানুষের বৃত্তি আদায় ।
কেউ যদি কানাকড়ি দিতে পারে বুকের উপরে হাত রেখে
তবে সে প্রেতের মতো৷ ভেসে গিয়ে সিংহ দরজায়
আঘাত হানিতে গিয়ে মিশে যায় অন্ধকার বিদ্বের মতন ।৮
কিংবা
“ওখানে চাদের রাতে প্রাস্তরে চাষার নাচ হতো
ধানের অদ্ভুত রস খেয়ে ফেলে মাঝি বাগদির
ঈশ্বরী মায়ের সাথে
বিবাহের কিছু আগে--বিবাহের কিছু পরে সম্ভানের
জন্মাবার আগে।
যে সব সন্তান আজ এ যুগের কু-রাষ্ট্রের মূঢ়
ক্লাস্ত লোর্ক-সমাজের ভীড়ে চাপা পড়ে মৃতপ্রায় ।”
আবার সমাজের নীচু স্তরের সর্বহারাদের প্রতিও কবির হাদয় ছিল
দরদে ভরা । তাই তিনি লিখেছেন £
জীবনানন্ ৯১
“জীবনের ইতর শ্রেণীর
মানুষ তো এরা সব? ছেঁড়া জুতো পায়ে
বাজারের পোকা-কাট। জিনিসের কেনা-কাটা! করে ৮
কিংবা
“জানে না কোথায় গেলে জল তেল খাগ্ঠ পাওয়া যাবে,
অথব৷ কোথায় মুক্ত পরিচ্ছন্ন বাতাসের ন্গিগ্চতীর আছে ।”
হাসপাতাল সৃষ্টি হয়েছে গরীবদের চিকিৎসার জন্তে । কিন্তু কবি
দেখতে পেয়েছেন, হাসপাতালের বেড্ গরীবের জহ্যে নয়। তাই
তিনি সখেদে লিখেছেন £
“বেড আছে বেশী নেই--সকলের প্রয়োজনে নেই।
যাদের আস্তানা ঘর তক্লিতল্লা নেই
হাসপাতালের বেড হয়তো তাদের তরে নয়।
ঢের ব্যর্থ অন্ধকারে
যার! ফুটপাত ধরে অথবা ট্রামের লাইন মাড়িয়ে চলেছে
তাদের আকাশ কোন্ দিকে %
আবার ধার! আর্ত, নিপীড়িত মানুষের জন্তে নতুন সমাজব্যবস্থা
গড়ে তুলতে চান, কবি তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেছেন £
“যারা এই সব মৃত্যু রোধ করে এক সাহসী পৃথিবী
স্থবাতাস সমুজ্জল সমাজ চেয়েছে_
তাদের ও তাদের প্রতিভ। প্রেম সংকল্পকে ধন্যবাদ দিয়ে
মানুষকে ধন্তবাদ দিয়ে যেতে হয়।”
শহরের ফুটপাতে অর্ধ-উলঙ্গ নীর্দ নরনারীকে ভাস্টবিন থেকে
৯২ জীবনানন্ৰ
পচা খাবার কুড়িয়ে খেতে দেখে কবির দরদী হৃদয় হাহাকার করে
উঠেছে। তিনি তাই সখেদে লিখেছেন 3
“্বতঃই বিমর্ষ হ'য়ে ভদ্র সাধারণ
চেয়ে গ্ভাখে তবু সেই বিষাদের চেয়ে
আরে বেশি কালে! কালে! ছায়৷
লঙ্গরখানার অন খেয়ে
মধ্যবিত্ত মানুষের বেদনার নিরাশার হিসাব ডিডিয়ে
নর্দমার থেকে শূন্য ওভারত্রিজে উঠে
নর্ঘমায় নেমে-_
ফুটপাত থেকে দূর নিরুত্বর ফুটপাতে গিয়ে
নক্ষত্রের জ্যোৎনায় ঘুমাতে বা মরে যেতে জানে ।”?
স ন্ এ
জীবনানন্দের কাব্য নিয়ে আলোচনা করতে হলে এক বিরাট
গ্রন্থ ফেদে বসতে হয় ; কিন্তু এই হ্বল্লায়তন গ্রচ্থে কবির কাব্য নিয়ে
পুর্ণ আলোচন! করবার মত স্থযোগ ন৷ থাকায় আমর! এখানে বুদ্ধদেব
বন্ুর লেখা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করে এই প্রসঙ্গের সমাপ্তিরেখ!
টানছি।
বুদ্ধদেব বনু তার “জীবনানন্দ দাশ-এর প্মরণে নামক প্রবন্ধের
উপসংহারে লিখেছেন £
“বাংলা কাব্যের এঁতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে তার
( জীবনানন্দের ) আসনটি ঠিক কোথায় সে বিষয়ে এক্সনই
মনস্থির করা সম্ভব নয়। তার কোনে প্রয়োজনও নেই এই
মুহুর্তে ; এই কাজের দায়িত্ব আমরা তুলে দিতে পারি আমাদের
ঈর্যাভাজন সেই সব নাবালকদের হাতে, যারা আজ প্রথমবার
জীবনানন্দের স্বাহুতাময় আলো-অন্ধকারে অবগাহন করছে।
আপাভতঃ আমাদের পক্ষে এই কথাই কৃতজ্ঞচিত্তে দ্মর্তব্য যে,
'ধুগের সঞ্চিত পণ্যে'র 'অগ্নিপরিধি'র মধ্যে দাড়িয়ে বিনি
জীবনানন্দ ১৩
“দেবদারু গাছে কিন্নরক্' শুনেছিলেন, তিনি এই উদ্ভ্রান্ত
বিশৃঙ্খল যুগে ধ্যানী কবির 'উদাহরণ স্বরূপ ।৮
জীবনানন্দের কবি-সত্বা সম্বন্ধে সক্ষেপে আলোচনা করা হলো ।
এবার তার ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে আলোচনা করা হচ্ছে ।
॥ বংশ-পরিচয় ॥
আধুনিক বাংলা কবিতার অন্ততম পথিকৃৎ জীবনানন্দ দাশ
আজ্ব বাংলার কাব্য-জগতে একটি বহু-আলোচিত নাম। বাংলার
শিক্ষিত সমাজে জীবনানন্দ আজ ন্ুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর কবিত৷ পড়েননি
একথা যদি কেউ বলেন তাহলে তিনি হবেন উপহাসের পাত্র ।
এ হেন কবির জীবনকথ! জানবার জন্যে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত
সমাজ আগ্রহান্বিত। আমরা তাই এখানে কবির জীবন-কথা সংক্ষেপে
আলোচনা করছি ।
কবির প্রপিতামহ বলরাম দাশের (দাশগ্গ্তর ) পৈত্রিক নিবাস
ছিল ঢাক! জেলার বিক্রমপুর অঞ্চলের গাইপাঁড়া গ্রামে। গ্রীমটি
পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল বলে দাশ-পরিবারের বাড়িটি পদ্মার
ভাঙনে নিশ্চিহ হয়ে যায়। এর পর বলরামের পুতেররো বরিশালে
এসে ঘর বাঁধেন এবং পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবার সময়
পর্যস্ত সেখানেই বাস করেন ।,
বলরাম দাশের তিন পুত্ত। জ্যেষ্ঠ তারিণীচরণ, মধ্যম ভোলানাথ
এবং কনিষ্ঠ সর্বানন্দ। এই কনিষ্ঠ পুত্র সর্ধানন্দই হলেন কবির
পপিতামহ। ....
সর্বানন্দ দাশের সাত পুত্র ও চার কন্া। পুত্রেরা, হলেন--
৯৪ জীবনানন্দ
হরিচরণ, সত্যানন্দ, যোগানন্দ, অতুলানন্দ, প্রেমানন্দ, ব্রহ্মীনন্দ ও
জ্ঞানানন্দ । কন্যার! হলেন প্রিয়ন্বদা, প্রেমদা, বিনোদ! এবং ন্েহলতা ।
এদের মধ্যে বিনোদ! বিবাহের আগেই লোকাস্তরিত। হন এবং
কনিষ্ঠ স্লেহলতা৷ আজীবন কুমারী থেকে দেশের ও দশের সেবায়
জীবন উৎসর্গ করেন। বাকি ছুই কন্তার মধ্যে প্রিয়ম্বদার বিবাহ হয়
পাঞ্াব-প্রবাসী ব্রজেন্দ্রনাথ সেনের সঙ্গে এবং প্রেমদার বিবাহ হয়
কোটালীপাড়ার মনোমোহন চক্রবতীরি সঙ্গে ।
এবার পুত্রদের কথা বলছি। সর্বানন্দের "সাত পুত্রের মধ্যে
জ্ঞানানন্দ অবিবাহিত থাকেন এবং বাকি ছয় পুত্র বিবাহ করে
সংসারী হন। হরিচরণের স্ত্রী স্ুশীলাবালা, সত্যানন্দর স্ত্রী কুস্থমকুমারী,
যোগানন্দের স্ত্রী প্রসন্নকুমারী, প্রেমানন্দের স্ত্রী স্প্রভা এবং অতুলানন্দের
স্ত্রী সরযুবাল!। |
এদের মধ্যে সত্যানন্দ এবং কুস্থমকুমারীই হলেন কবির
পিতা-মাতা । কুস্মকুমারী গৈলা গ্রামের চন্দ্রনাথ দাশগুগ্তর জ্ঞোষ্ঠা
কম্ঠা। কবি হিসেবেও ইনি ছিলেন সুপরিচিত । তার লেখা একটি
বিখ্যাত কবিতায় ছুটি লাইন হলো ঃ
“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে,
কথায় ন। বড় হয়ে কাজে বড় হবে ।”
এই পিতামাতার স্নেহচ্ছায়াতলেই বর্ধিত হয়েছেন কবি জীবনানন্দ
দাশ।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কবির পিতামহ সর্বানন্দ দাশ ব্রান্ষাধর্ম
গ্রহণ করেছিলেন। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধাসমিক,
বন্ধুবংসল এবং পরহিতব্রতী। ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের পরে তিন ব্রাহ্ম-
সমাজের পক্ষে প্রচারকের কাজ নেন।
ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক হবার ফলে সে-আমলের অনেক মনীষী,
ব্যক্তির সঙ্গে তিনি পরিচিত হন এবং অনেক বিখ্যাত লোকের
সঙ্গে তার, বন্ধুত্ব হয়। তার গুণগ্রাহী ব্যক্তিদের মধ্যে ধাদের নাম
জীবনানন্ ৯৫
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ভারা হলেন বরিশালের অশ্থিনীকুমার দণ্ড,
কলিকাতার দুর্গীমোহন ও ভুবনমোহন দাশ এবং বিখ্যাত মনীষী
ও ব্রাহ্মদমাজের অন্যতম স্তস্ত শিবনাথ শান্ত্রী। এছাড়া আরও বনু
লোকের সঙ্গে তার পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়।
সর্বান্দ যখন ব্রা্গধর্ম গ্রহণ করেন তখন তার ছুই পুত্র
(হরিচরণ ও সত্যানন্দ ) জন্মগ্রহণ করেছেন। পরে আরও পাঁচ
পুত্র এবং চার কন্তা জন্মগ্রহণ করেন।
এখানে একটি কথা বলে রাখা দরকার যে, সর্বানন্দ ব্রাহ্মধর্ম
গ্রহণ করলেও তিনি তার হিন্দু আত্মীয়-্ঘজনের কাছ থেকে দূরে
সরে যাননি । তাছাড়৷ হিন্দু সমাজের আত্মীয়দের সাম্তবনার জন্যে
সর্বানন্দ তার জেষ্ঠ পুত্র হরিচরণকে হিন্দু সমাজের মধ্যেই রেখে দেন।
হরিচরণ এবং সত্যানন্দ প্রথমে বরিশালের জেলা স্কুলে কিছুদিন
পড়াশুনা করেন। পরে ওঁরা কলিকাতায় এসে সিটি কলেজিয়েট
স্কুলে ভর্তি হন। হরিচরণ থাকতেন কলকাতার একটি মেসে
এবং সত্যানন্দ থাকতেন ভবানীপুরের স্বনামধন্য ছুর্গীমোহন দাশের
বাড়িতে । |
সত্যানন্দ আলাদা থাকলেও প্রায়ই দাদার সঙ্গে দেখা করতে
তার মেসে যেতেন। সেখানেই একদিন ডাকযোগে পিতার মৃত্যু
সংবাদ আসে। সংবাদটি পড়ে ছুই ভাই তখন একেবারেই দিশেহারা!
হয়ে পড়েন। সত্যানন্দ ছুটে যান তীর পিতৃবন্ধুদের কাছে। তার!
অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন সর্বানন্দ দাশের বিপন্ন পরিবারের
সাহায্যে । শোন! যায় যে, আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী সে সময় তাদের
নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন ।
পিতৃবিয়োগের পরে শোকার্ত ভ্রাতৃদ্বয় চলে গেলেন বরিশালের
পৈত্রিক বাঁড়িতে। সেই সময় সর্বানন্দের বন্ধুগণ (হ্র্গীমোহন দাশ,
রাখালচন্দ্র, জগতচন্্র, ' গিরিশচন্দ্র এবং স্বনামধন্ত অশ্বিনীকুমার দত্ত )
সর্বানন্দের পরিবারকে নানাভাবে সাহায্য করেন।
১৬ জীবনানন্দ
তবে পিতৃবন্ধদের কাছ থেকে সাহায্য পেলেও হরিচিরণ এবং
সত্যানন্দের লেখাপড়ায় ইতি হয়ে গেল। শুরু হলে জীবন-সংগ্রাম ।
হরিচরণ পোস্ট অফিসে চাকরি নিলেন এরং সত্যানন্দ হবিগঞ্জের একটি
স্কুলে শিক্ষকত৷ শুরু করলেন। এর পর দুর্গীমোহন দাশের চেষ্টায়
সত্যানন্দ বাংলা! সরকারের অধীনে একটি চাকরি পান; কিন্তু সে
চাকরিতে তিনি বেশি দিন থাকতে পারেননি । সরকারী চাঁকরি
পরিত্যাগ করে আবার তিনি শুক করেন শিক্ষকতা । এইভাবে এক
ভাই পোস্ট অফিসে চাকরি করে এবং অপর ভাই ব্রজমোহন স্কুলে
শিক্ষকতা এবং প্রাইভেট টিউশানি করে অতি কষ্টে সংসার চালাতে
লাগলেন। ও
এদিকে বিপদের ওপরে বিপদ । বরিশালের যে বাড়িতে সর্বানন্দ
বাস করতেন সে বাড়িটি দাশ পরিবারের হস্তচ্যুত হয়ে যায়। তাদের
তখন বাধ্য হয়ে একট! ভাড়াটে বাড়িতে উঠে আসতে হয়।
দাশ পরিবারের সেই বিপদের দিনে তাদের সাহায্যে এগিয়ে
এলেন জগৎচন্দ্র গুণ্ডের স্ত্রী মুক্তকেশী গুপ্ত । তিনি তার বসতবাড়ি
সংলগ্ন একখণ্ড জমি হরিচরণ ও সত্যানন্দকে দিলেন এবং সেখানে
তাদের বাড়ি তৈরি করতে বললেন। বাড়ি তৈরি হতে দেরী হলো না ।
এর পর তারা ভাড়াটে বাড়ি থেকে আবার উঠে এলেন নিজেদের
বাড়িতে ।
এই বাড়িটি সম্বন্ধে সত্যানন্দ লিখেছেন £$ “আমাদের যে নিজ
গৃহ থাকিবে না, বাড়ি থাকিবে না, দাদার তাহা সহা হইত না।
গুপ্ত পরিবারের যে জায়গায় আমাদের হৃ'তিনখানি গৃহ ছিল তাহা
দাদারই একাস্ত যত্ব ও পরিশ্রমের ফল।”
এই বাড়িতে কিছুদিন বাস করবার পর হরিচরণ. এবং সত্যানন্দ
আর একটি নতুন বাসভবন তৈরি করে সেখানে উঠে যান। এই
ভবনের নামকরণ কর! হয় “সর্বানন্দ ভবন" ।
পিতৃপরিচয় প্রসঙ্গে জীবনানন্দ বলেছেন £ আমরা শিক্ষা
জীষনানন্দ ৯৭
পেয়েছিলাম তিনজন মানুষের কাছে__একজন হলেন আমাদের বাব,
অপরজন মা, এবং তৃতীয়জন হলেন স্কুলের হেডমাস্টার জগদীশ
মুখোপাধ্যায়।***জীবনের য! কিছু কাগুজ্ঞান, মর্সজ্ঞান, রসাম্বাদ বা
কিছু লোকসমাজের এঁবণাশক্তি কিংবা নির্জনে ভাবন৷ প্রতিভা য! কিছু
[00016 120 যা কিছু সংবাদকে বিচ্ভায় পরিণত করতে পারে,
বিদ্াকে জ্ঞানে-সমস্ত জিনিসেরই অস্তাপন ও বিধিনিয়ম এদের
কাছ থেকে লাভ করবার স্থযোগ হয়েছিল আমার।
এবার জীবনানন্দর মাতৃবংশ সম্বন্ধে আলোচনা করছি। ইতিপুব
জীবনানন্দের মাতৃবংশের যে কুলুজী দেখা যায়--তা থেকে জানতে
পারা যায় যে, তার মা কুম্থমকুমারী দাশ ছিলেন চন্দ্রনাথ গুপ্তর দ্বিতীয়
সম্ভান। চন্দ্রনাথ অত্যন্ত রসিক মানুষ ছিলেন । তার রচিত হাসির
গান একসময় পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে খুবই আদরণীয় ছিল।
মাত কুন্থমকুমারী সম্বন্ধে জীবনানন্দ লিখে গেছেন £
আমার ম৷ কুন্থমকুমারী দাশ বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি কলকাতার বেথুন স্কুলে পড়তেন । খুব সম্ভব ফার্ট ক্লাশ
পর্যস্ত পড়েছিলেন । তার পরেই তার বিয়ে হয়ে যায়। তিনি
অনায়াসে বিশ্ববিদ্ভালয়ের শেষ পরীক্ষায় খুব ভালভাবে পাস
করতে পারতেন, এ বিষয়ে সন্তানদের চেয়ে তার বেশি শক্তিই
ছিল।...সাহিত্য পড়ায় ও আলোচনায় মাকে বিশেষ অংশ
নিতে দেখেছি । দেশী বিদেশী কোন কোন কবি ও ওপন্তাসিকের
কোথায় কি ভালো, কি বিশেষ জিনিস দিয়ে গেছেন তারা»
এসবের প্রথমপাঠ তার কাছ থেকেই নিয়েছি। শেলী, ব্রাউনিং,
ওয়ার্ডসুওয়ার্থের অনেক ছোট ছোট কবিতা তার মুখে শুনেছি ।
বৈধব পদাবলী থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যস্ত আমাদের দেশের
কবিতার মোটামুটি এভিহা জেনে ও বিদেশী কবিদের কাউকে
কাউকে মনে রেখে তিনি তার স্বাভাবিক কবি-মনকে। শিক্ষিত,
৪৮
জীবনানন্দ
ও স্বতন্ত্র করে রেখেছিলেন ।"*"ম1' বেশি লেখার সুযোগ পেলেন
না। খুব বড় সংসারের ভিতর এসে পড়েছিলেন যেখানে
শিক্ষা ও শিক্ষিতদের আবহাওয়া ছিল বটে কিন্তু দিনরাতের
অবিশ্রান্ত কাজের ফাকে সময় করে লেখা তখনকার দিনের
সেই অসচ্ছল সংসারের একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে শেষ পর্যস্ত
সম্ভব হয়ে উঠল না আর। "তিনি আরো লিখলে বাংলা
সাহিত্যে কিছু দ্রিয়ে যেতে পারতেন ।*."মার কবিতার আশ্চর্য
প্রসাদগুণে অনেক সময়ে বেশ ভালে! কবিতা ব৷ গদ্য রচন৷
করেছেন দেখতে পেতাম । সংসারের নানান কাজকর্মে খুব ব্যস্ত
আছেন এমন সময়ে ব্রক্গবাদীর সম্পাদক আচার্য মনোমোহন
চক্রবততী এসে 'বললেন-_-“এক্ষুণি ব্রক্মবাদীর জন্তে তোমার
কবিতা চাই । প্রেসে পাঠাতে হবে । লোক দ্রাড়িয়ে আছে।”
-আমার লেখা কোন কবিতা তো! নেই এখন !
_ লিখে দাও। আমি বসছি।
শুনে মা কলম খাতা নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে এক হাতে খুস্তি আর
এক হাতে কলম নাড়ছেন দেখা যেত। যেন চিঠি লিখছেন।
বড় একটা ঠেকছে না কোথাও । আচার্য চক্রবরতীকে প্রায়
তখনই কবিত৷ দিয়ে দিলেন । স্বভাব-কবিদের কথা মনে
পড়ে আমার। আমাদের দেশের লোক-কবিদের স্বভাবী
সহজতাকে। অনেক আগে প্রথম জীবনে মা কয়েকটি কবিতা
লিখেছিলেন । যেমন, “ছোটনদী দিনরাত বহে কুলকুল;” অথবা
“দাদার চিঠি” কিংবা “বিপাশার পরপারে হাসিমুখে রবি ওঠে”।
একটি শীস্ত, সুম্মিত ভোরের আলো, শিশির লেগে রয়েছে
যেন এসব কবিতার শরীরে ৷ সে দেশ মায়েরই স্বকীয় ভাবনা
কল্পনার ত্বীয় দেশ। কোনো সময় এসে সেখান থেকে
এদের স্থান্চ্যুত করতে পারবে ন1।”
॥ শিক্ষা ও বিবাহ ॥
পাঠশালায় শিক্ষা শেষ হলে জীবনানন্দকে ভণ্তি করা হয়
বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলে। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন
জগদীশ মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন সত্যিকারের শিক্ষাব্রতী ও
শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি । তাই জীবনানন্দের মেধা ও স্মৃতিশক্তি দেখে
তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তার শিক্ষার ব্যাপারে সব রকমে সাহায্য
করতে এগিয়ে এসেছিলেন। এই আদর্শ শিক্ষকের অনুপ্রেরণাতেই
কবি তার জীবনের উন্নতির সোপানের সন্ধান পেয়েছিলেন এবং তার
আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই জীবনের অনেকগুলি সোপান অনায়াসে
পার হতে পেরেছিলেন।
ব্রজমোহন স্কুল হতে প্রথম বিভাগে ম্যাটরক পাস করে তিনি
ভি হন ব্রজমোহন কলেজে । এই কলেজ হতে কার্ট ডিভিসানে
আই. এ. পাস করে তিনি কলকাতায় এসে প্রেসিড্দৌ কলেজে
বি. এ. ক্লাসে ভি হন। বি. এ. পাস করবার।পর তিনি ইংরেজীতে
এম. এ. পড়তে থাকেন।
এই প্রসঙ্গে কবি-জায়া লাবণ্য দাঁশ লিখেছেন £
“১৯২১ সনে কলকাতা বিশ্ববিষ্ঠালয় থেকে ইংরেজীতে
হাই সেকেও ক্লাস পেয়ে এম. এ. পাশ করেন। কবির মুখে
শুনেছি--পরীক্ষার কিছুদিন আগে তিনি দারুণ ব্যাসিলারী
ডিসেন্টি রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন। এ বছর পরীক্ষা দিতে
পারবেন না বলে তার মাকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু নান!
অন্থবিধে থাকাতে মায়ের অনুমতি পেলেন না। বাধ্য
' হলেন পরীক্ষ। দিতে-_কিন্তু প্রথম শ্রেণীর সম্মান আর পেলেন
ন! তিনি।
১০০ জীবনানন্দ
এম. এ. পাশ করার পরে তিনি সিটি কলেজে অধ্যাপনার কাজ
নিয়ে তার কর্মজীবন আরম্ভ করেন ।
সিটি কলেজে কিছুদিন অধ্যাপনা করবার পর তিনি দিল্লীর
রামযশ কলেজে ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান
করেন। এই কলেজে অধ্যাপন। করবার সময়ই তার বিবাহ হয়।
এই বিবাহ প্রসঙ্গে তার স্ত্রী শ্রীমতী লাবণ্য দাশ যে সুন্দর
বিবরণীটি লিপিবদ্ধ করেছেন, আমরা এখানে তা হুবহু তুলে দিলাম।
শ্রীমতী দাশ লিখেছেন £
«১৯৩০ সনে যখন তিনি দিল্লীর রামযশ কলেজে
ছিলেন, সেই সময়েই আমার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের
ব্যাপারে তার যে চরিত্রবৈশিষ্ট্য ছিল, তার কিছুটা পরিচয়
এখানে দিচ্ছি ।
আমাকে বিয়ে করবার আগে এক ধনী ভদ্রলোকের
মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাব আসে । তিনি নিজেই মেয়ে
দেখতে গেলেন--সঙ্গে ছিলেন তার মেসোমশাই ( বাণীপীঠ
বিদ্ভালয়ের প্রধান শিক্ষক ) রসরঞ্জন সেন।
পাত্রী পক্ষের আপ্যায়নের ক্রটি ছিল না। মেসোমশাই
তো৷ তাদের ব্যবহারে মুগ্ধ। কবি কিন্ত সব সময় চুপ করেই
রইলেন। এমন কি, সালঙ্কারা মেয়েটিকে দেখে এবং তাকে
বিলেতে পাঠাবার প্রস্তাব শুনেও কোন কথাই বললেন না।
বাড়ি ফেরার পরে মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে কিনা সে-কথ।
বার বার জিগ্যেস করেও কবির কাছ থেকে কোন উত্তরই
পাওয়া গেল না।
পরদিন হপুরে আর একবার যাবার অন্থরোধ জানিয়ে
পাত্রী পক্ষ গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। কবি তখনও যেন চিন্তা
করছেন। মেসোমশাই তাকে যাবার জন্কে তৈরি হতে
বললেন। কিন্তু তিনি বললেন, 'তুমি যাও, আমি যাব না।'
জীবনানন্দ ১০১
“সেকি কথা! বিয়ে করবি তুই, আর যাব আমি ?
মেসোমশাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ।
কবি কিস্তু ধীরভাবেই উত্তর দিলেন, “যেখানে বিয়ে
করব না বলেই ঠিক করেছি, সেখানে দ্বিতীয়বার যাওয়াটা
আমি অনুচিত বলেই মনে করি ।'
সেদিন মেসোমশাই-এর শত অন্থুরোধও তাকে তার
সংকল্প থেকে টলাতে পারেনি ।
আবার এ ব্যাপারে তিনি যে কতটা উদার ছিলেন তার
পরিচয় পেয়েছি আমার বিয়ের সময়। বিয়েতে একটিমাত্র
আংটি ছাড়া বোতাম, ঘড়ি অথবা আসবাব কিছুই তাকে
দেওয়া হয়নি । কিস্ত সেই আংটিটির জন্যই তিনি কত লজ্জিত,
কত কুষ্িত। যেন মহা-অপরাধে অপরাধী । + বিয়ের পরে
বরিশালে গিয়ে তার বড় পিসীমাকে বলেছিলেন, “তোমরা
যদি বলে দ্দিতে, তাহলে আমি নিজেই একটা আংটি কিনে
নিয়ে যেতাম । আমার জন্য লাবণ্যর জ্যেঠামশাইকে শুধু শুধু
কতগুলো টাকা ব্যয় করতে হ'ল। তাছাড়া বিয়ে করতে
গেলে কিছু-না-কিছু পেতেই হবে--এ নিয়মই বা আছে
কেন”
কবির কথা শুনে বড় পিসীম! হাসিমুখে উত্তর দিলেন,
“সমাজের দোহাই দিচ্ছিস কেন? তোর! না নিলেই পারিস।
কিন্তু আমি তে! দেখি বিয়ের সময় বেশিরভাগ ছেলে বাপ
মায়ের অতি বাধ্য হয়ে “বাবা মায়ের কথায় উপরে আমি কি
কিছু বলতে পারি'_-এই কথাই বলে বসে।
কবি তার এই তেজন্বিনী পিসীমাকে ভাল করেই
চিনতেন। তাই আর কথ! না বাড়িয়ে সেখান থেকে সরে
পড়াই শেয়ঃ মনে করলেন ।”
ক ও ০
রবীজানাখ-” ৭
১০২ জীবনানন্দ
বিয়ের আগে কনে দেখা বাঙালী হিন্দু সমাজের একটি চিরাচরিত
প্রথা। জীবনানন্দের বেলাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তাঁর এই
কনে দেখ৷ প্রসঙ্গে কবি-জায়। শ্রীমতী লাবণ্য দাশের লেখা চমৎকার
বিবরণীটি পাঠকদের উপহার দেবার লোভ সামলাতে পারছি ন1।
শ্রীমতী দাশ লিখেছেন $
«পান! বিশ্ববিষ্ঠালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে আমি
তখন সবেমাত্র ঢাকা! ইডেন কলেজে ভণ্তি হয়েছি। হোস্টেলে
থাকি। হঠাৎ একদিন সকালে শুনলাম জ্যেঠামশাই বাড়িতে
ডেকে পাঠিয়েছেন 1...
আগের দিন বৃষ্টি হওয়াতে রাস্তায় কাদা জমেছে । আমি
সেই কাদার ভিতর দিয়েই হেঁটে চলেছি । ফলে আমার
শাড়ীর পাড় আর জুতোর রং ছুয়েরই চেহারা! একেবারে অন্য
রকম। সেই অবস্থায় বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম ।
মাথায় লম্বা বেশী, কোমরে আচল শক্ত করে জড়ান।
পায়ে আর শাড়ীর পাড়ে কাদা। আমার দিদি তো
আমাকে দেখে হেসেই অস্থির ৷ আমি চটে গিয়ে বললাম,
হাসি থামিয়ে এখন দয় করে কিছু খেতে দিয়ে বাধিত কর।'
এমন সময় জ্যেঠামশাই দোতলা থেকে হাক দিয়ে
বললেন, “মা লাবণ্য, কয়েকখানা লুচি নিয়ে এস তো!
দিদি লুচির পান্রটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়েই হাসি
চাঁপতে চাপতে দূরে সবে গেল।' আমিও সেটা নিয়ে হুমদাম
শব্ধ করতে করতে উপরে চলে গেলাম ।
জ্যেঠামশাইকে ঝাঁঝের সঙ্গে কি একটা' বলতে যাব,
তাকিয়ে দেখি সেখানে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন ।
তিনি আমার দিকে একবার তাকিয়েই তাড়াতাড়ি চোখ
ফিরিয়ে নিলেন।
জ্যেঠামশাই আমাকে বললেন, “এই যে মা, এস আলাপ
জীবনানন্দ ১০৩
করিয়ে দি। এরর নাম জীবনানন্দ দাশগুপ্ত । দিল্লী থেকে
এসেছেন। আমার তখন রাগের বদলে হানদির পাল'
ছোটবেলা থেকে বেশ ভালভাবেই হাসিটি আয়ত্ত করেছিলাম ।
হাসি সামলাতে না পেরে ভদ্রলোকের দিকে পিছন ফিরেই
একটা টুলের উপর বসে পড়লাম ।
জ্যেঠামশাই বার বার বলতে লাগলেন, “ওকি, পিছন
'ফরে বসেছ কেন? ঠিক হয়ে বস। বাড়িতে অতিথি এলে
ঠিকভাবে আপ্যায়ন না করাটা খুবই অন্যায় । ইনি তোমাকে
কি ভাবছেন ? ৃ
“ইনি' নামক ব্যক্তিটি যাই ভাবুন না৷ কেন, ঠিক হয়ে
বসব কি-আমি তখন আমার হাসি সামলাতেই ব্যস্ত।
যাই হোক, কিছুক্ষণ চেষ্টার পর আমি তার দিকে কিরে
বসলাম কিন্তু অসীম ধের্য ভদ্রলোকটির। যতক্ষণ পর্যস্ত
না ফিরলাম, তিনি ঠিক চুপ করেই বসে রইলেন।
তার দিকে ফেরার পরে তিনি আমাকে তিনটি প্রশ্ন
করলেন । “আপনার নাম কি ? “মাই-এ তে কি কি সাবজেক্ট
নিয়েছেন ? এবং “কোন্টি আপনার বেশি পছন্দ ?
কোনও মতে প্রশ্ন তিনটির উত্তর দিয়ে ভদ্রলোককে কিছু
না বলেই উঠে নীচে দৌড় দিলাম । রান্নাঘরে ঢুকেই দিদিকে
গুম-গুম শব্যে কিল মারতে আরম্ভ করলাম। দিদি আমার
হাত হুখান! শক্ত করে ধরে রেখে বলল, “তোর হ'ল কি?
আমি আরও রেগে গেলাম ' “আমার কেন হ'তে যাবে ?
হয়েছে তোমাদের, আজ তোমরা আরম্ভ করেছ কি? এঁ
ভত্রলৌোকটি কে? আর আমাকে সাত সকালে পাঠাবারই
বামানে কি? দিদি তখন “আমি কিজানি? ভদ্রলোকটির
খবর তো! তোরই রাখবায কথা” বলেই অন্ক ঘরে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরে জ্যেঠামশাই সেই ভদ্রলোকটিকে নিয়ে
জীবনানম্্
নীচে নেমে বাইরের দিকে চলে গেলেন। আমি তাঁদের
দেখেই মুখ ফিরিয়ে বসে রইলাম ।
ছপুর বেলা জ্যেঠামশাই আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে
এ-কথা সে-কথার পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, লাবণ্য
মা, সকালের ভদ্রলোৌকটিকে তোমার কেমন লাগল ? আমি
পাণ্টা প্রশ্ন করলাম, 'উনি এসেছিলেন কেন % উত্তরে জ্যেঠ'-
মশাই বললেন, “তাহলে বলি শোন। উনি দিল্লীর রামযশ
কলেজের একজন অধ্যাপক । তোমাকে দেখতে এসেছিলেন ।,
আমি তখন পরিক্ষ।র জানিয়ে দিলাম যে, বি-এ পাশ না৷ করে
বিয়ের কথ! ভাববই না।
ছেলেবেলায় মাত্র তিন মাসের তফাতে বাবা মা
ছ'জনকেই হারিয়েছিলাম বলে আমাদের অকুতদার জ্যেঠা-
মশাই ( অমৃতলাশ গুপ্ত) তার সবটুকু সহ ঢেলে ছ'জনের
জায়গাই পুর্ণ করতে চেষ্ট। করতেন। তিনি আমাকে অনেক
বোঝালেন, তুমি যে বিয়ে করতে চাইছ না, আমি চোখ
বুজলে তোমাকে কে দেখবে? তোমার দিদির বিয়ের কথা
চলছে । হয়ত শিগগিরই ঠিক হয়ে যাবে । তোমার ছোট বোনটি
খুবই ছোট। তার বিয়ের কোন প্রশ্নই ওঠে না। স্মৃতরাং
তোমার জন্যই আমার এখন চিন্তা । তাছাড়া উনি তে
তোমাকে পড়াতে রাজী আছেন। তাহলে তোমার বিয়েতে
আপত্তি করারকি আছে?
সত্যিই তো! বাবা মা নেই, দিদির বিয়েও ঠিক হচ্ছে;
এখন আমার বিয়ে হয়ে গেলেই জ্যঠামশাই দায়মুক্ত হবেন ;
অতএব মত আমাকে দিতেই হবে । তবুও, শেষবারের মত
ৰললাম, "ভদ্রলোকের মত না জেনেই আমাকে জিজ্ঞেস
করছেন কেন? তখন জ্যোঠামশাই হাসতে হাসতে বললেন,
“তিনি সকালে তোমাকে দেখেই মত দিয়েছেন ।
জীবনানন্দ ১৪৫
আমার তখন অবাক হবার পালা । ছোটবেল! থেকে
শুনে আসছি কত রকমভাবে সাজিয়ে-গুজিয়ে তবে মেয়েকে
বর পক্গীয় লোকের সামনে ফাড় করাতে হয়। তারা হাজার
রকম প্রশ্ন করে ঘুরিয়ে-কিরিয়ে পরীক্ষা করে তবেই মতামত
দেন। মেয়েদের সে এক ভীতিজনক অবস্থা । কিন্তু আমার
বেলা !
সে যাই হোক, ২৬শে বৈশাখ শুক্রবার বিয়ের দিন ঠিক
হয়ে গেল। কবির কবিত্বশক্তির কোন রকম পরিচয় তখনও
আমরা পাইনি । আমাদের কাছে তিনি অধ্যাপক হিসেবেই
পরিচিত হলেন ।,
এ ও হী
এবার শ্রীমতী লাবণ্য দাশের পিতৃ-মাতৃ পরিচয় দিচ্ছি । শ্রীমতী
দাশের পিতার নাম রোহিশীকুমার গুপ্ত । তিনি ছিলেন খুলন। জেলার
সেনহাটি গ্রামের অধিবাসী ।
শ্রীমতী লাবণ্যর মায়ের নাম সরধূ গুপ্ত (সেন)। ইনি ছিলেন
যশোহর জেলার ইতিন৷ গ্রামের তারাপ্রসন্ন সেনের একমাত্র সন্তান ।
লাবণ্যর দিদির নাম প্রমীলা গুপ্ত । বি. এন রেলওয়ের প্রাক্তন
কমাপিয়াল ট্রাফিক ম্যানেঞ্জার বসন্তকুমার দে-র সঙ্গে এর বিয়ে হয়।
প্রমীলাই ছিলেন রোহিণীবাবুর প্রথম সন্তান এবং লাবণ্য হলেন দ্বিতীয়
সম্তান। লাবণ্যর ছোট ভাই স্ত্রী শাস্তিবিন্ু গুপ্ত এবং ছোট বোন
নন্দিনী গুপ্ত। শাস্তিবিন্দু এখন একটি ব্রিটিশ ফার্মের মাদ্রাজ শাখার
ম্যানেজার । নন্দিনীর বিয়ে হয়েছে বার্ন কোম্পানীর ওয়েলফেয়ার
অফিসার নিশীথ ঘোষের দে ।
॥ আদর্শ মানুষ ॥
লোকে বলে, কবিরা নাকি আলাদা জগতের মানুষ । সংসারে
কি হচ্ছে না-হচ্ছে, কে কি করছে, তার কোন হিসেবই নাকি কবিরা
রাখেন না। তাঁরা সব সময় মত্ত থাকেন তাদের কবিতার খাতা
নিয়ে। কিন্তু কবি জীবনানন্দ ছিলেন এর বলিষ্ঠ ব্যতিক্রম । খ্যাতনাম৷
কবি হওয়া সত্বেও তিনি ছিলেন আদর্শ পুত্র, "আদর্শ স্বামী, আদর্শ
পিতা, আদর্শ বন্ধু এবং আদর্শ শিক্ক। এক কথায় বল! চলে তিনি
একজন আদর্শ মানুষ ।
চালচলন এবং আচার-ব্যবহারে তিনি ছিলেন একেবারেই
সাধারণ মানুষ । কখনো তিনি চিৎকার করে কথা বলতেন না এবং
মিলের মোটা ধুতি ছাড়! অন্য কাপড় পরতেন ন!।
কবি ছিলেন মা-অন্ত প্রাণ । মায়ের ন্েহ-কোমল স্পর্শ না পেলে
কোন কিছুই তার ভা লাগত ন1।
বাইরে থেকে কৰিকে দেখলে মনে হতো, তিনি খুব গম্ভীর
প্রকৃতির মানুষ, কিন্তু সেই গান্তীর্ষের আড়ালে লুকিয়ে থাকত তার
কৌতুকপ্রিয়ত। । তবে যার-তার সঙ্গে তিনি কৌতুক করতেন না! ।
তার কৌতুকের পাত্র ছিলেন তার দাছ চন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত । ভিনি
বাড়িতে এলেই কবির মুখের ওপর থেকে গাস্ভীর্বের ছন্প-আবরণ
খসে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠত কৌতুকের সিদ্ধ হাসি ।
একবার দাহু স্নান সেরে কার একখানা শাড়ি পরেছেন। তাকে
সেই শাড়ি-পড়া অবস্থায় দেখে কৰি তার কাছে এগিয়ে এসে হীসতে
হাসতে বললেন-_-কি হে চন্দরনাথ, "শাড়ির পাড়ই পছন্দ হছইচে ?
চুল আচড়ানের কাকই পাইছ ? তোমারে আর কি ভ্ভাওন যায়-_-
কও!
জ।বনানন্দ ১৬৭
কবির কথা শুনে দাছ এক হাঁতে তার নাতিকে অন্ত হাতে নাত
বৌকে (লাবণ্যকে ) জড়িয়ে ধরে সে কালের একটি অতি-পরিচিত
হাঁসির গান গেয়ে শুনালেন । গানটি হলো
“বাঁজার ছগ্া কিন্তা আহন্যা
' ঢাইল৷ দিছি পায়,
তোমার লগে ক্যামতে পারুম
হইয়া উঠেছে দায়।
আরসি দিচি, কাকই দিচি,
চুল বাঁধনের ফিতা! দিচি,
আর কি গ্াওন যায় ?”
কবি ষে ছাত্র-দরদী ছিলেন সে-কথা আগেই বলেছি। ছাত্ররা
তাকে অন্তরের সঙ্গে শ্রদ্ধা করত। ছাত্রদের তিনি কতখানি
ভালবাসতেন সে সম্বন্ধে এখানে ছোট একট ঘটনার উল্লেখ
করছি। সেদিন ছিল “হোলি উৎসব। সকালে একদল ছাত্র
বাড়িতে এসে কবির পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করতে লাগল । এই
সময় তাদের মধ্যে একজন লাবণ্যর ঘরে ঢুকে তাকে বললে-_
“আপনাকে রঙ দেব ।
আবির দেওয়াট। লাবণ্য একেবারেই পছন্দ করতেন না। তাই
তিনি বেশ একটু রুক্ষকঞ্ঠেই বলে দিলেন যে, আবির দেওয়া
চলবে না।
কবির বাবা সেই সময় পাশের ঘরে ছিলেন। তিনি সেই
ছেলেটিকে ডেকে কঠোরভাবে তিরস্কার করলেন অনুমতি না নিয়ে ঘরে
ঢুকবার জন্তে। ছেলেটি অপরাধীর মত মুখ নিচু করে বাড়ি থেকে
বেরিয়ে গেল।
ছেলেরা চলে গেলে কবি তার স্ত্রীকে বললেন-_-হোলির
সময় রঙ দেওয়াটা আমাদের দেশে একট। রীতি। এই দিনে ছাত্র!
১০৮ জীবনানন্ব
অধ্যাপকদের বাড়িতে গিয়ে আবির দিয়ে সন্ত্রীক তাদের শ্রদ্ধা জানায়।
তোমাকে ঠিক সেইভাবেই দিতে “এসেছিল । ন্নান করলেই তো রঙ
উঠে যেত। তুমি এত বিরক্ত হলে কেন?'
কবির কথায় সেদিন কবি-জায়া খুবই লজ্জিত হয়েছিলেন ।
আর একদিনের কথা । কবি তখন কলকাতার ল্যাব্সডাউন
রোডে একখান। বাড়ি ভাড়। নিয়ে থাকেন। তখন কলকাতায় হিন্দু
মুসলমানে দাঙ্গা চলছে। দাঙ্গাট। প্রথম দিকে মুসলমানরা শুরু
করলেও শেষদিকে তারাই মার খাচ্ছিল বেশি। বেগতিক দেখে
বাংলার মুসলিম লীগ গভর্নমেন্ট তখন মিলিটারি তলব করলেন
মুসলমানদের বাঁচাবার জগ্ভে। সৈনিকদের বুঝানো হলো যে,
হিন্বুরাই দাঙ্গাবাজ এবং ওরাই যত নষ্টের গোড়া। ওদের বেশ
ভালোভাবে শায়েস্তা করা দরকার । সৈন্তরা তখন ট্রাকে করে
শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে শুরু করলো দাঙ্গাবাজ হিন্দুদের শায়েস্তা!
করবার জন্য ।
এমনি সময় একদিন কবি ক্রীক রে! দিয়ে ফিরছেন, হঠাৎ তিনি
দেখতে পেলেন, রাস্তার লোকেরা দৌড়ে যে যেদিকে পারছে
পালাচ্ছে। একটু পরেই একখান! মিলিটারি ট্রাক এসে তার সামনে
থামল। ট্রাক থেকে একজন অফিসার নিচে নেমে এসে কবির দিকে
তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন- আর ইউ এ হিন্ডু ?
হতচকিত হয়ে পড়লেন কবি। তবুও সাহসে ভর করে উত্তর
দিলেন- ইয়েস।
_ আই থিংক ইউ আর দ্য রিং/লীডার অফ দিস এরিয়া । জাস্ট
গেট অন্।
কবি কিছু বলতে চাইছিলেন । কিন্ত তারা তাকে কিছু বলতে
ন! দিয়েই জোর করে ট্রাকে তুলে থানায় নিয়ে গেল। থানার ও. সি.
ছিলেন কবির একজন প্রাক্তন ছাত্র । কবিকে দেখে তিনি সসম্ত্রমে
জীবনানন্দ ১০৯
ঠার কান্ছে এসে ক্ষম! প্রার্থন! করলেন এবং নিজে সঙ্গে করে তাকে
নিরাপদ এলাকায় নিয়ে এসে ট্রামে চড়িয়ে দিয়ে গেলেন।
বাড়িতে গিয়ে কবি যখন তীর প্রাক্তন ছাত্রটির কথা সকলের কাছে
বলছিলেন তখন ছাত্রের গর্বে ভার চোখ-সুখ উজ্জল হয়ে উঠছিল।
রা ঙঁ চে
কবির মেয়ে মধুণ্রী তখন আই-এ পড়ছে । কবির কৰিত্ব শক্তির
কিছুটা অংশ সে পেয়েছিল। তাই শৈশব কাল থেকেই সে কবিতা
লিখতে শুরু করেছিল । মঞ্ুর সেই সময়কার লেখ! একটি কবিতা
একটি পত্রিকাতে ছাপাও হয়েছিল ।
কবি তার মেয়ের সঙ্গে অনেকটা বন্ধুর মতন ব্যবহার করতেন।
একদিনের একটি ঘটনার কথা বলছি। ৃ
লাবণ্য কবির অমতেই মেয়ের বিয়ের চেষ্টা করছিলেন তখন।
তার সেই প্রচেষ্টার ফলে একদিন একটি ছেলে মঞ্জুকে দেখতে
এলো । ছেলেটি ভাল ঘরের এবং ভাল চাকরি করে।
ছেলেটি এলে লাবণ্য যখন তাকে কবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে
দিতে গেলেন, তখন ছেলের চাইতে তার বেশভৃষার দিকেই কবির
বেশি নজর দেখ! গেল।
এদিকে মেয়ের কাণ্ড আরও সাংঘাতিক। সে জানতো না যে,
তাকে দেখবার জন্তেই ছেলেটি এসেছে । সে তাই যেন অন্ভুত কিছু
দেখছে এমনিভাবে তাকাতে লাগলে ছেলেটির দিকে ।
৮7৮ বদায় নিলে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে কবি জিজ্ঞেস
করলেন-_-একে তুমি যোগাড় করলে কোথা থেকে 1
-- কেন, ওর দোষটা কি হলে! ?
- না, দোষ কিছুই হয়নি । তবে এই ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে
একে ধূতি পরানো! শেধাডে-শেখাতেই মেয়ের জীবন কেটে যাবে। কি
বলিস মঞ্ছ? |
১১০ জীবনানন্দ
মেয়েও তেমনি। সঙ্গে সঙ্গে সে বলে উঠলো--ও বাঝ!! , এই
ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে নাকি? যেভাবে কাপড় পরেছে,
আমি তো বাঙালী বলে বুঝতেই পারিনি ।
ঠিক বলেছিস। এক [সাবধানে থাকিস। এর পরে তোর মা
আবার কি এনে হাজির করবেন কে জানে !
কবির কথা শুনে লাবণ্য বেশ একটু রাগৈর সুরে বললেন-_ খুব
হয়েছে! আর বলতে হবে না। কিন্তু মেয়ের বাবা যখন রোহিণী
গুপ্তের মেয়েকে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন, তখন তার কৌচাটা কত
লম্বা'ছিল শুনি ?
কবি তখন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মৃছ্ধ'হেসে বললেন £
“সে যুগ হয়েছে বাসী,
সে যুগেতে আর এ যুগেতে এবে
তফাৎ অনেক বেশী ।”
ব্যক্তি জীবনানন্দের এই হলো! সংক্ষপ্ত পরিচয় ।
॥ অকালে ঝরিল ফুল ॥
বাংলার সেই প্রিয় 'কবি আক আর নেই। অকালেই ঝরে গেছে
ফুল। থেমে গেছে বাংলার বুলবুলের কণ্ঠন্বর চিরদিনের মত। আর
কোন দিন তাব লেখনী থেকে বের হবে না! কোন কবিতা ।
আজ বারে বারে মনে পড়ছে কবির সেই কবিতাটি--যাতে
তিনি লিখে গেছেন £
“আমার মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে
চাই আর? জানি না কি তাহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো
এসে জাগে,
ধূসব মৃত্যুর মুখ । একদিন পৃথিবীতে
স্বপ্ন ছিলো সোন৷ ছিলে! যাহা
নিকত্বর শাস্তি পায়, যেন কোন্ মায়াবীর
প্রয়োজনে লাগে ।”
সঙ্গে সঙ্গে মারও একটি কবিতার চারটি লাইন আমার মনে
পড়ছে ঃ
«আবার আসিব কিরে ধানসিড়িটির তীরে--এই বাংলার
হয়তে। মানুষ নয় -হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;
হয়তো৷ ভোরের কাক হয়ে এই কাত্তিকের নবায়নের দেশে
কুয়াসার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কীঠাল ছায়ায় ।”
সত্যিই কি আবার তুমি আসবে? আবার তুমি বাজাবে তোমার
ক্ষবিতার বীণা ? হায়, কে দেবে এ প্রশ্থের উত্তর!
১১২ জীবনানন্দ
সব শেষে কবি জায়ার লেখা থেকে আর একটি উৃতি দিয়ে
আমাদের বক্তব্য শেষ করছি।
“বাংল! মায়ের যে কয়জন সন্তান বিশ্বের দরবারে টন
আসন স্ুপ্রতিষিত করে গিয়েছেন, কবি জীবনানন্দ তাদের
অন্যতম, যশোলক্ষমী যখন জয়”গৌরবের মাল। হাতে তার দিকে
এগিয়ে এলেন- ঠিক সেই সময়েই হেমস্তের কবি হেমস্তেরই
এক কুয়াশা-ঢাঁকা রাত্রে চিরদিনের মতই হারিয়ে গেলেন-
হারিয়ে গেলেন রহস্যময় রাজপুরীর সোপানাবলী ধরে কোন্
এক অন্ধকার গুহাকক্ষে। রঙে-রসে-ন্বপ্ে ভর! এই পৃথিবী ।
চোখে তার মায়ার কাজল ।* কিন্তু মহাকালের ডাক যখন'
আসে, তখন ধরিত্রী মায়ের বুক খালি করে নিরুদদেশের পথে
বেন্িষে আমাদের পড়তেই হবে। আশা-আকাজ্া-ভালবাঁস
সবকিছুই মায়াবী মৃত্যুর হাতে তুলে দিয়ে অনস্ত চিস্তা-ভাবনার
পরিসমাপ্তির রেখ! টানতেই হয় ৮
কবি জীবনানন্দ আজ নেই। কিন্তু মরদেহে বিদ্যমান না! থাকলেও
তিনি বেঁচে আছেন প্রতিটি বাঙালীর হাদয়-মাঝে। মরেও তিনি
অমর হয়ে আছেন। এবং অমর হয়েই থাকবেন চিরদিন।
॥ শেব ॥